জলকন্যা পিয়াইন এখন বালুর মাঠ
স্বচ্ছ জলের নিচে নানা রঙের নুড়িপাথর। ঢেউয়ের তালে মাছের ছোটাছুটি- জলকন্যা পিয়াইন নদের এমন অপরূপ দৃশ্য দেখে মন জুড়াত প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের। যান্ত্রিক নাগরিক জীবনের ক্লান্তি মুছতে পর্যটকরা গা ভিজিয়ে নিতেন পিয়াইনের শীতল জলে। জাফলংয়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া পিয়াইন ছিল পর্যটকদের কাছে এক অমোঘ আকর্ষণ। কিন্তু সেই স্বচ্ছ জলরাশির পিয়াইন এখন অস্তিত্বহীন। উৎসমুখ ভরাট আর পরিবেশ ধ্বংস করে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনের ফলে পিয়াইন নদ পরিণত হয়েছে ধু-ধু বালুর মাঠে। দীর্ঘ সময় ধরে এ অবস্থা বিরাজমান থাকলেও পিয়াইন নদকে বাঁচাতে নেই কোনো উদ্যোগ।
সিলেটে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ভারতের ওম নদ বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ে প্রবেশ করে দুটি শাখায় প্রবাহিত হয়েছে। নদটির একটি শাখা ডাউকি নাম ধারণ করে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের মুখতলা এলাকায় সারি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। অপর শাখাটি পিয়াইন নামে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদীর সঙ্গে মিশেছে।
পিয়াইন নদ ছিল খরস্রোতা। জাফলংয়ে এসে পর্যটকরা নদের স্বচ্ছ জলে নেমে জলকেলিতে মেতে উঠতেন। নৌকা দিয়ে নদে ঘুরতে ঘুরতে আয়নার মতো স্বচ্ছ জলের নিচে ঝাঁকে ঝাঁকে ভেসে চলা মাছ দেখে অন্য রকম এক আনন্দে ডুবে যেতেন পর্যটকরা। নির্মল প্রকৃতির মধ্যে থাকা অপরূপ পিয়াইন নদের বুকে অসংখ্য চলচ্চিত্রেরও শুটিং হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে পিয়াইন নদ পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে। নদের উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এর বুকে নেই জলের প্রবাহ। এ ছাড়া জাফলংয়ে অপরিকল্পিতভাবে পরিবেশবিধ্বংসী বোমা মেশিন ও এক্সাভেটর দিয়ে পাথর উত্তোলন করার ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পিয়াইন নদে। বালুর স্তূূপ জমে নদের বুকে পড়েছে চর। বর্ষাকালে পানির যৎসামান্য প্রবাহ থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে একেবারে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয় পিয়াইন। তখন কেউ কল্পনাও করতে পারে না যে বালুভূমি দিয়ে তারা হেঁটে যাচ্ছেন সেটি একদিন নদ ছিল।
স্থানীয় সংগ্রামপুঞ্জির বাসিন্দা বৃদ্ধ কেনাং মিচাং বলেন, ‘বহু বছর আগে পিয়াইন নদ ছিল যৌবনে পূর্ণ। নদের বুক চিরে স্বচ্ছ জলের ধারা বয়ে যেত। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা পিয়াইনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন। পিয়াইন নদের পানি নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতেন আশপাশের বাসিন্দারা। এখানে চলচ্চিত্রের শুটিং হতেও দেখেছি আমরা। কিন্তু এখন সবই যেন স্মৃতি। পিয়াইন মরে যাচ্ছে। নদটি বাঁচাতে কারও কোনো তৎপরতাও নেই।’ সিলেটে পরিবেশ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আবদুল হাই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একদিকে উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়া, অন্যদিকে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলন। ফলে পিয়াইন নদ মৃতপ্রায়। একটি নদী মরে যাওয়া মানে প্রাণ ও পরিবেশের ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়া। পিয়াইনকে রক্ষা করতে খননকাজসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’
সিলেটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতের ওম নদ বাংলাদেশে প্রবেশ করে পিয়াইন ও ডাউকি নাম ধারণ করেছে। ১৯৮৮ সালে এক ভূমিকম্পে পিয়াইন নদের উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে পিয়াইন নদে পানির প্রবাহ কমতে থাকে। পিয়াইন নদ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে ডাউকি নদীতে পানির চাপ বেশি থাকে। এতে ওই নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়।’ তিনি বলেন, ‘পিয়াইন নদের উৎসমুখ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় পড়েছে। এ জন্য উৎসমুখ খনন করতে হলে যৌথ নদী কমিশন গঠন করতে হবে।’
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.