বছরে ৮ লাখ নতুন বেকার
প্রতি বছর নতুন করে আট লাখ কর্মক্ষম মানুষ বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। কেননা চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। গত ১০ বছরে আর্থ-সামাজিক খাতে অনেক উন্নয়ন হলেও কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত সংলাপের মাধ্যমে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিপিডি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। আলোচক হিসেবে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ডা. রশিদ ই মাহবুব। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডিরি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সংলাপে ‘স্টেট অব দ্য বাংলাদেশ ইকনোমিক অ্যান্ড ন্যাশনাল ইলেকশন-২০১৮ প্রাইরেটস ফর ইলেক্টরাল ডিবেটস’ নামে একটি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান সরকারের জন্য রয়েছে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধিসহ পাঁচটি চ্যালেঞ্জ। এগুলো হচ্ছে- কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি থেকে বেরিয়ে এসে যুব কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, বৈষম্য বৃদ্ধি রোধ করা, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা ও মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় কমিয়ে আনা এবং দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। সিপিডির ‘কক্সিক্ষত সামাজিক উন্নয়নের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি : ইস্যুজ অ্যান্ড প্রাইওরেটিস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন এবং সংলাপে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোও বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়।
প্রতিবেদন তৈরিতে বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ২১ লাখ কর্মক্ষম মানুষ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু প্রতি বছর কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ। এক্ষেত্রে প্রতি বছর ৮ লাখ কর্মক্ষম মানুষ কাজ পায় না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১১ সালে ৬ শতাংশ থাকলেও পরে তা বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভালো অবস্থানে রয়েছে দেশ। সেই সঙ্গে ২০১৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। সেটি কমিয়ে এখন ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে দুটি অন্যতম ভাবনার বিষয় হচ্ছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও সে তুলনায় কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। অন্যটি হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সুফল সর্বত্রই সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে না। যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক নয়। বৈষম্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ধনী ৫ শতাংশের তুলনায় সর্বনিম্ন ৫ শতাংশের আয় বৈষম্য ব্যাপক বেড়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ১৯৯১-৯২ সালে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ধনীর আয় ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সেটি বেড়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে। অন্যদিকে উল্টো চিত্র গরিবদের ক্ষেত্রে। ১৯৯১-৯২ সালে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ গরিবের আয় ছিল ১ দশমিক ০৩ শতাংশ। সেটি কমে গিয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশে। প্রবৃদ্ধির সুবিধা সমানভাবে বিতরণ না হওয়ায় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে বলা হয়েছে, হাসপাতালগুলোতে অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও তার মানসম্মত ব্যবহার হচ্ছে না। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু কমানোসহ স্বাস্থ্য খাতে অনেক সুনাম অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু তারপরও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার অভাব রয়েছে। এক্ষত্রে সম্পদের সীমাবদ্ধতা, পেশাদারিত্বের অভাব এবং নিম্নমানের ব্যবস্থাপনা ও নীতিগত উদ্যোগকেই দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষের ব্যক্তিপর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে অনেক। কিন্তু সরকারিভাবে গত ১০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিপ্রতি ব্যয় বেড়েছে ২০৫ টাকা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এম এ মান্নান বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ৯০ শতাংশের বেশি সঠিক সুবিধাভোগীরাই পাচ্ছেন। স্বাস্থ্য খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। হাজার হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। তারপরও কিছু ব্যর্থতা রয়েছে। মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, মানুষের আয় বাড়ছে। মানুষ এখন সরকারি হাসপাতালে যেতে চায় না। বেসরকারিভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে। ফলে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। আমরা চাই বৈষম্য দূর হোক।
ড. রেহমান সোবহান বলেন, মানসম্মত শিক্ষা এখন অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য খাতেও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশে দারিদ্র্য নিরসন হলেও জিডিপির সুফল সমানভাবে সব অংশে পৌঁছাচ্ছে না। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
মুহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, স্থানীয় সরকারগুলোকে ধীরে ধীরে শক্তিশালী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শিক্ষা খাতে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া হয় না। কিন্তু শিক্ষা খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি না করলে এত প্রবৃদ্ধি হয় কীভাবে। তবে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সুশাসন যে কোনো সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তার, ডিসি ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের হেদায়েত করার জন্য শিক্ষা দিতে হবে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পুরনো ১৭টি জেলাকে টেস্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বেশকিছু ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। আলোচনায় আরও অংশ নেন প্রফেসর ড. রওনক জাহান, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা চৌধুরী মুফাদ আহমেদ প্রমুখ।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.