গোল্ডেন রাইস: ভালো না খারাপ?
বাংলাদেশের কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা উদ্বেগ জানিয়ে বলছে, 'গোল্ডেন রাইস' নামের যে নতুন জাতের জেনেটিক্যালি মডিফাইড ধান চাষাবাদের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাওয়া হয়েছে, সেই অনুমতি যেন দেয়া না হয়। তাদের বক্তব্য, এই ফসল বাংলাদেশের পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
তবে গোল্ডেন রাইস নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, এটি নতুন ধরনের একটি ফসল যা দরিদ্র মানুষের শরীরে ভিটামিন এ-র অভাব মেটাতে সহায়তা করবে।বর্তমানে গোল্ডেন রাইস নামের ধানটি পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে।
গোল্ডেন রাইস কী?
সাধারণত চালের রঙ সাদা হলেও এই চালের রঙ হয়ে থাকে হলদে সোনালি। এটি আসলে জেনেটিক্যালি মডিফাইড একটা শস্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিআর-২৯ জাতের ধানের সঙ্গে ভুট্টার জিন মিলিয়ে এই গোল্ডেন রাইসের জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।এর সাথে জড়িত রয়েছে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং মার্কিন দাতব্য সংস্থা বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
ভুট্টা অথবা ড্যাফোডিল ফুল থেকে নেয়া 'ফাইটোন সিনথেজ' জিন এবং মাটির এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে নেয়া 'ক্যারোটিন ডিস্যাচুরেজ' জিন ধানের জিনোমে প্রবেশ করিয়ে এই গোল্ডেন রাইস প্রস্তুত করা হয়। এর ফলে ধানের ভেতর ভিটামিন এ (বিটা ক্যারোটিন, যা ভিটামিন এ-র পূর্বের অবস্থা) তৈরি হয়।গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের জন্য ব্রি-২৯ জাতের ধানকে জেনেটিক্যালি মডিফাইড করার জন্য বহুজাতিক সিনজেনটা কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের ব্রির একটি চুক্তি হয়। এর ফলে সিনজেনটা ব্রি-২৯ জাতের ধানে ওই দুটি জিন সংযোজন করে বাজারজাত করবে।
এর ফলে কি লাভ হবে?
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বিবিসিকে বলছেন, বাংলাদেশের অনেক মানুষ, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের মধ্যে ভিটামিন এ এর অভাব দেখা যায়। সরকারি ক্যাম্পেইনেও তাদের কাছে ভিটামিন এ পৌঁছানো যাচ্ছে না, আবার এই ভিটামিন পাবার জন্য দরকারি খাবারও তারা খাচ্ছেন না।''কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশে, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোয় ভাত প্রধান খাদ্য, তাই ভাতের সঙ্গে এই ভিটামিনটি মিশিয়ে দেয়া গেলে তাদের শরীরে ভিটামিন এ পৌঁছানো সম্ভব হবে। ফলে রাতকানা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো সমস্যা ঠেকানো যাবে।'' তিনি বলছেন, এখনো এই ধানটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা শুরু হবে।
পরিবেশ কর্মীদের উদ্বেগ
তবে এই গোল্ডেন রাইস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের পরিবেশ কর্মীরা।উবিনীগ নামের একটি সংস্থার প্রধান ফরিদা আক্তার বলছেন, ''এ ধরনের জিএম খাবার চালু করার মতো পরিবেশ এখনো বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। কারণ এ ধরনের একটি ফসল চালু করতে হলে পরিবেশের ওপর, অন্যান্য ফসলের ওপর যে প্রভাব পড়বে, তা যাচাই করে দেখা হয়নি। এ ধরনের ফসল চালুর আগে বায়োসেফটির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।''
তিনি বলছেন, জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফসলে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত অনেক ঝুঁকি থাকে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়নি। আর বাংলাদেশের মতো দেশে এরকম ফসলের দরকারও নেই। কারণ অনেক খাবারে ভিটামিন এ পাওয়া যায়, বরং সেসব খাবার খেতে উৎসাহ তৈরি করতে হবে।'' তারা দাবি করছেন, পাঁচ বছর আগে বিটি বেগুন নামের যে জিএম ফসলটি চালু করা হয়েছিল, একটি নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে সেটির ভালোমন্দ আগে যাচাই করে, নতুন করে কোন জিএম ফসলের অনুমতি দেয়া না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।তাদের আশঙ্কা, এর ফলে বীজের নিয়ন্ত্রণ চাষিদের কাছ থেকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে চলে যেতে পারে। যদিও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধান থেকে কৃষকরা নিজেরাই বীজ তৈরি করতে পারবেন।
জিএম খাবার কি ক্ষতিকর?
এ নিয়ে এখনো বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।উবিনীগের মতো সংস্থা যেখানে এই ধরনের জিন পরিবর্তন করা ফসলের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, সেখানে ব্রি'র সাবেক প্রধান মি. বিশ্বাস বলছেন, এতে উদ্বেগের কিছু নেই।তিনি বলছেন, নব্বুই দশকের শেষ থেকে সয়াবিন, টমাটো, গমসহ অনেক জিএম উদ্ভিদ অনেকদিন ধরেই পশ্চিমা দেশগুলোয় চাষাবাদ হচ্ছে, এখনো এসব ফসলের ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি। সেখানে কোথাও পরিবেশ বা স্বাস্থ্যের ওপর বিষাক্ততা বা অ্যালার্জির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর ধান যেহেতু স্বপরাগী ফসল, তাই এটি থেকে অন্য কোথায় কিছু ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনাও নগণ্য।
তবে উবিনীগের প্রধান ফরিদা আক্তার বলছেন, অনেক দেশে জিএম ফসলের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা গেছে। যেহেতু ক্ষতি একবার হয়ে গেলে সেটা ফিরিয়ে আনা যাবে না, তাই ফসল মাঠ পর্যায়ে অনুমতি দেয়ার আগে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে হবে।তার অভিযোগ, এ ধরনের ফসলের ক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের যেভাবে পরীক্ষা করে দেখা উচিত, সেটা করা হচ্ছে না।কর্মকর্তারা বলছেন, গোল্ডেন রাইসের পরিবেশগত নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা চালানো হবে এবং সেই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করবে যে এই ফসলটি ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে কিনা।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.