নওগাঁয় এক রাতে তৈরি ঐতিহাসিক দিবর দীঘি
স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ও স্যার বুকানন হ্যামিলটনের পরিদর্শন করা নওগাঁর ঐতিহাসিক দিবর দীঘিটি এক রাতে খনন করা হয়েছিল বলে কথিত আছে। প্রাচীন স্থাপত্য পুরাকীর্তির অনুপম নিদর্শন এবং হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসেবে আজো দ-ায়মান এ দীঘির বিজয় স্তম্ভ। আর সেটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভিড় জমাচ্ছেন। ইতিহাস সমৃদ্ধ দিবর দীঘি বরেন্দ্রভূমি জেলার পত্নীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নের দিবর গ্রামে অবস্থিত। দীঘিটিকে ঘিরে লোকমুখে অনেক গল্পকাহিনী বা কাল্পনিক গল্প-কথা প্রচলিত। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের কথা অনুযায়ী, জনৈক বিষু কর্মা নামে এক বীর এক রাতে এবং অন্যদের মতে, জিনের বাদশাহর হুকুমে এক রাতে বিশাল আকৃতির এই দীঘিটিকে খনন করা হয়। তবে আজ অবধি বিজ্ঞানসম্মতভাবে জানা যায়নি, দেশের কোন কৃতী সন্তান এই প্রাচীন দীঘি ও স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা গেছে, দিবর বা ধীবর নামে পরিচিত এই বৃহৎ জলাশয় ও জলাশয়ের মাঝখানে অবস্থিত স্তম্ভটি একাদশ শতাব্দীর কৈবর্ত্য রাজা দিব্যক তার ভাই রুদ্যকের ছেলে নৃপতি ভীমের কীর্তি হিসেবে পরিচিত। পাল রাজা দ্বিতীয় মহিপালের (১০৭০-১০৭১ খ্রি.) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বরেন্দ্রভূমির অধিকাংশ অমর্ত্য পদচ্যুত সেনাপতি ধীবর বংশো™ভূত কৃতী সন্তান দিব্যকের নেতৃত্বে পাল শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় মহিপালকে হত্যা করেন।
পরে সর্বসম্মতিক্রমে দিব্যককে বরেন্দ্রভূমির অধিপতি নির্বাচন করা হয়। অল্পকাল পরে দিব্যক মারা গেলে প্রথমে রুদ্যকের ছেলে ভীম সিংহাসনে বসেন। তিনিই একমাত্র কৈবর্ত্য বংশীয় রাজা, যিনি প্রায় ২৫-৩০ বছর বরেন্দ্রভূমি শাসন করেন। পরে দ্বিতীয় মহিপালের ভাই রামপাল ভীমকে পরাজিত ও হত্যা করে রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। তবে কোন কৃতী কৈবর্ত্য রাজা বিজয় স্তম্ভটি নির্মাণ করেছিলেন তা আজ অবধি সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে স্যার আলেকজান্ডার কনিংহামের মতে, শৌর্যদের পরে এ ধরনের কোনো পাথরের কাজ বাংলার অঞ্চলে আর হয়নি। সেই ভিত্তিতে প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম জাকারিয়ার মতে, বিজয় স্তম্ভটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে নির্মিত হওয়া সম্ভব। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা একটি অখ- পাথর কেটে তৈরি এই স্তম্ভের ৯টি কোন রয়েছে। এর এক কোন থেকে অপর কোনের দূরত্ব ১২ ইঞ্চি। স্তম্ভের উপরিভাগে পর পর তিনটি বলয়াকারে স্মিত রেখা রয়েছে, যা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এর শীর্ষদেশ নান্দনিক কারুকার্য খচিত মুকুটাকারে নির্মিত। পানির উপরিভাগে স্তম্ভের উচ্চতা ১০ ফুট, পানির ভিতর ১০ ফুট এবং মাটির নিচে ১০ ফুট। স্যার বুকানন হ্যামিলটনের মতে, স্তম্ভের দৈর্ঘ্য ৩০.৩৪ ফুট। অপরদিকে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের মতে, দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে যখন এই দীঘি পরিদর্শনে আসেন তখন এর গভীরতা ছিল ১২ ফুট এবং এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ছিল ১২০০ ফুট। বর্তমানে দিবর দীঘির জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ২০ একর। বর্তমানে ঐতিহাসিক এই দিবর দীঘিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বনভোজন ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে শত শত মানুষের সমাগম ঘটছে। প্রকৃতির অপরূপ নয়নাভিরাম এই দীঘির চতুর্দিকে রাজশাহী সামাজিক বনবিভাগ কর্তৃক বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে কৃত্রিম বন, যা দীঘির সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ছায়া সুশীতল মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এদিকে দলমত নির্বিশেষে মানুষের দাবি, হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির শৌর্য-বীর্যের প্রতীক এবং প্রাচীন পুরাকীর্তির অনুপম নিদর্শন ঐতিহাসিক দিবর দীঘিকে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হোক।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.