সুপার-ঘূর্ণিঝড়-আম্পান!

  • ব্রেকিং নিউস

    সিরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসন

    সিরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন আগ্রাসন

    ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের সময় ইসরাইল সিরিয়ার ভূখণ্ড গোলান হাইটস দখল করেছিল। সেই থেকে গোলান ইসরাইলের দখলে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে এই দখলের স্বীকৃতি কোনো দেশই দেয়নি।তারা সবাই একমত যে, গোলান সিরিয়ার ভূখণ্ড এবং ইসরাইলকে এই ভূখণ্ড ফেরত দিতে হবে। জাতিসংঘও এই মর্মে একাধিক প্রস্তাব পাস করেছে ও নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তমূলক তৎপরতার কারণে ইসরাইল আজ পর্যন্ত সিরিয়াকে গোলান ফেরত দেয়নি এবং দাবি করেছে যে, গোলান হল ইসরাইলের অংশ।

    এই পরিস্থিতিতে সিরিয়া থেকে আইএস সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এ অঞ্চলে নতুন করে এক সংকটজনক অবস্থা সৃষ্টি করেছে। ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম হঠাৎ করে এক ঘোষণায় স্বাক্ষর করে বলেছেন যে, গোলান হল ইসরাইলের।গোলানের ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্বকে এভাবে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি দীর্ঘদিনের একটি ঝুলে থাকা সমস্যার ‘সমাধান’ করেছেন! মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঔদ্ধত্য যে কোন পর্যায়ে আছে এটা হল তার সাম্প্রতিক উদাহরণের একটি।

    ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ২৫ মার্চ তারিখেই হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার উপস্থিতিতেই ট্রাম্প উপরোক্ত ঘোষণায় স্বাক্ষর দেন।এখানে বলা দরকার যে, ইসরাইল কর্তৃক ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় শুধু গোলান দখল করাই নয়, তারপর ১৯৮১ সালে তারা গোলানকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে ঘোষণা করে। সেই ঘোষণা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে কেউই তাকে আজ পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয়নি।

    এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সব আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে চরম ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গোলানের ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করলেন। ইসরাইলের পক্ষে এই তার প্রথম কীর্তি নয়।২০১৭ সালে তিনি জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এক ঘোষণা জারি করেন। এটাও ছিল আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সম্পূর্ণ বরখেলাপ। তা সত্ত্বেও জেরুসালেমকে এই স্বীকৃতি দেয়ার পর কয়েকটি সাম্রাজ্যবাদী দেশও এ কাজ করেছে, যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনো দেশ এই স্বীকৃতিকে সমর্থন করেনি।

    প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন এত উলঙ্গভাবে তাদের সাম্রাজ্যবাদী আচরণ শুরু করেছেন, যা পূর্ববর্তী মার্কিন আগ্রাসনের মধ্যে খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যদিও বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে তাদের আগ্রাসী তৎপরতার কোনো শেষ থাকেনি।কিন্তু ট্রাম্প এখন বেশ খোলাখুলিভাবেই অর্থাৎ বেপরোয়াভাবে পশ্চাৎপদ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেশ মনে করে ইচ্ছেমতো কাজ করছেন। তিনি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েই বলছেন যে, প্রত্যেক দেশেই হস্তক্ষেপ করার অধিকার তার আছে, যদি দেখা যায় সেই দেশ দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

    এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ অন্য দেশকে ইচ্ছেমতো শোষণ করতে না পারা, তার ওপর নিজেদের নীতি চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হওয়া। এভাবেই এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করছেন, এমনকি হুমকি দিচ্ছেন তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে দেশটি দখল করার। এভাবেই তিনি উত্তর কোরিয়াকে বলছেন, তার সব পারমাণবিক আয়োজন মার্কিন যুক্তফ্রন্ট্রের কাছে হস্তান্তর করতে হব।এভাবেই তিনি আফগানিস্তানে সেখানকার সরকারকে ডিঙিয়ে সোজাসুজি তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সেখানে তাদেরকে ক্ষমতায় বসানোর চক্রান্ত করছেন। তিনি মনে করছেন, এসব কাজের অধিকার তার বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আছে। এ সবই তাদের এখতিয়ারভুক্ত।

    এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৬৭ সালের পর থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল ধরে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেখানে ইসরাইলের অধিকার মেনে নেয়নি এবং এ সমস্যার সমাধান সিরিয়ার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে হওয়ার কথা বলে এসেছে।জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও সর্বসম্মতভাবে এই অবস্থানই গ্রহণ করেছে। তা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন গোলানকে ইসরাইলের ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, অর্থাৎ তিনি গোলানকে তুলে দিয়েছেন ইসরাইলের হাতে। এ প্রসঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কার ভূখণ্ড কাকে হস্তান্তর করছেন তার ঠিক নেই। তার অবস্থা দেখে মনে হয় সিরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রদেশ, কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ নয়।

    প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গোলান সম্পর্কিত ঘোষণার পর সিরিয়া জাতিসংঘের কাছে চিঠি দিয়ে এখনই নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বানের দাবি জানিয়েছে। গোলানে সিরিয়া ও ইসরাইলের সীমান্তে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অবস্থান নিয়েও নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হওয়ার কথা।ইতিমধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি ও পোল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাজের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, তারা গোলান হাইটসকে মনে করে ইসরাইল কর্তৃক অধিকৃত ভূখণ্ড। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবে যে আন্তর্জাতিক নীতি অনুসরণের কথা বলা আছে, সেই অনুযায়ী গোলান মালভূমি ইসরাইল কর্তৃক সিরিয়ার কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

    সিরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর চক্রান্তের বিষয় সবারই জানা। দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ায় তারা ‘regime change’-এর কথা বলে আসছে বেশ প্রকাশ্যেই।লিবিয়া ধ্বংস ও অধিকার করার পর তারা সিরিয়ায় যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তাকে তারা গৃহযুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করলেও আসলে সেটা কোনো গৃহযুদ্ধ ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে আইএসের সন্ত্রাসীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সিরিয়ার বিরুদ্ধে নিযুক্ত করেছিল।

    তার সঙ্গে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকটতম সহযোগী ও হুকুমবরদার সৌদি আরব। তারা সিরিয়ায় আইএসকে প্রভূত অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। এছাড়া সিরিয়ায় শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষ চাগিয়ে তোলার জন্য তারা অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপও খাড়া করেছিল।তারা সবাই সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে দেশটিকে অস্থিতিশীল করে সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ করে। এসবের বিরুদ্ধে সিরিয়া সরকার ব্যাপক সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে শেষপর্যন্ত তাদেরকে পরাজিত করে।পরে আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে সিরিয়ায় মার্কিন সৈন্য নামানো হয় এবং তারা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। মাত্র কয়েকদিন আগেই সে লড়াইও শেষ হয়েছে এবং সমগ্র সিরিয়ায় এখন প্রেসিডেন্ট আসাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

    এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে সিরিয়ার বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন চক্রান্তমূলক তৎপরতা। সেই তৎপরতার ফলই হল তার দ্বারা হঠাৎ করে গোলানকে ইসরাইলের ভূখণ্ড হিসেবে তার ঘোষণা। এই ঘোষণা তিনি স্বাক্ষর করেছেন হোয়াইট হাউসে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উপস্থিতিতে।এর একটা অতিরিক্ত কারণ হল, ইসরাইলের আসন্ন নির্বাচনে নেতানিয়াহুকে সাহায্য করা। কারণ ব্যাপক আকারে লুটপাট ও চুরি-দুর্নীতির কারণে ইসরাইলে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে মামলা চলছে। তার নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে ইসরাইলের জনগণও তার অপসারণ চাইছেন।কিন্তু ট্রাম্প নেতানিয়াহুর একজন শক্তিশালী সমর্থক। তিনি চান নির্বাচনে নেতানিয়াহুর জয়। এক্ষেত্রে সহায়তার জন্যই তিনি আগে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এখন গোলানকে তুলে দিতে চেষ্টা করছেন ইসরাইলের হাতে।

    গোলান সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণা আপাতদৃষ্টিতে হঠাৎ মনে হলেও এটি সিরিয়ার বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘদিনের চক্রান্তেরই অংশ। এজন্য দেখা যাবে সিরিয়ার যুদ্ধে ইসরাইলের ভূমিকা ছোট করে দেখার নয়। তারা সিরিয়ায় আহত আইএস সৈন্যদেরকে ইসরাইলে নিয়ে এসে তাদের হালকাভাবে চিকিৎসা করে আবার সিরিয়ায় ফেরত পাঠিয়েছে।এছাড়া অন্য নানাভাবেও তারা আইএসকে সাহায্য করেছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলে এসেছে যে, আইএস বা আল-কায়দা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণ করেনি। অর্থাৎ তারা হল ইসরাইলের এক ধরনের বন্ধু। কাজেই সিরিয়ায় তাদের কথিত গৃহযুদ্ধে ইসরাইল সবসময়েই চেয়েছে প্রেসিডেন্ট আসাদের সরকারের বিরুদ্ধে আইএসের জয়।

    এবার আশা যেতে পারে অন্য একটি বিষয়ে। ইসরাইল সরকার গোলানে তেলের রিজার্ভের সন্ধান পেয়েছেন। এই তেল যাতে সিরিয়ার হাতে কোনোভাবেই না যায়, সেটাও তড়িঘড়ি করে গোলানকে ইসরাইলের হাতে তুলে দেয়ার চক্রান্তের অন্যতম মূল কারণ।সিরিয়ার পুনর্নির্মাণের জন্য তেল খুব প্রয়োজন। সিরিয়াকে তাদের নিজেদের তেল থেকে বঞ্চিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বদিকের কিছু এলাকা নিজেদের দখলে রেখেছে। সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেনি। গোলানে তেলের সন্ধানের কথা দুনিয়ার কাছে গোপন থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তা ভালোভাবেই জানা।

    এই তেল যাতে সিরিয়ার হাতে না যায় সেজন্য তারা ইতিমধ্যে গোলানে বেহরব ঊহবৎমু নামে একটি তেল কোম্পানি খাড়া করেছে, যার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হলেন ব্রিটিশ প্রতিপত্তিশালী ব্যাংকার রথসচাইল্ড, সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, সংবাদপত্র ব্যারন রুপার্ট মারডক এবং সিআইএ’র সাবেক ডিরেক্টর জেমস উলসি।গোলানে যে তেল আছে সেটা মার্কিনের প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। কাজেই সেখানে এ ধরনের কোনো স্বার্থ তাদের নেই। তাদের মূল লক্ষ্য হল সিরিয়াকে এই তেল থেকে বঞ্চিত রাখা।

    প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উন্মাদের মতো একের পর এক যেসব গণবিরোধী, বিভিন্ন দেশবিরোধী, এমনকি ধরিত্রীবিরোধী সিদ্ধান্ত তার দুই বছরের শাসনকালে নিয়েছেন, তার প্রতিটিরই ফলাফল মারাত্মক হতে বাধ্য।গোলান মালভূমি সিরিয়াকে ফেরত দেয়ার পরিবর্তে সেটা ইসরাইলকে দেয়ার যে ঘোষণা তিনি দিয়েছেন, এর ফলও যে মারাত্মক দাঁড়াবে এতে সন্দেহ নেই। এর ফলে শুধু যে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে তাই নয়, এর দ্বারা জাতিসংঘের কার্যকারিতা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে দুনিয়াজুড়ে নানান দেশে বিপর্যস্ত অবস্থা তৈরি হবে।

    No comments

    If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.

    পৃষ্ঠা

    সর্বশেষ খবর

    COVID-19 থেকে বাঁচার উপায় !