সুপার-ঘূর্ণিঝড়-আম্পান!

  • ব্রেকিং নিউস

    বিপর্যয় মোকাবেলায় জার্মান অভিজ্ঞতা

    বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন।

    কবাজারের চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ার এবং গুলশানের ডিএনসিসির কাঁচাবাজার; সাম্প্রতিক সময়ের তিনটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার স্থল। প্রথমটি অপরিকল্পিত শহর হিসেবে খ্যাত পুরান ঢাকায়।বাকি দুটি আমাদের আধুনিক শহরে। দুর্ঘটনাগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে। চুড়িহাট্টায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই ৭১ জন, আর বনানীতে মন্থরগতিতে নিহত হয়েছে ২৬ জন। গুলশানের ডিএনসিসি কাঁচাবাজারে পুড়েছে ২১১টি দোকান। তিনটি দুর্ঘটনাই ঢাকাবাসীর হৃদয়ে শোক আর ভয়ের দাগ কেটেছে।

    চুড়িহাট্টা দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও করণীয় নির্ধারণে কাজ করছে কমিটি। আশা করি গ্রহণযোগ্য কিছু উঠে আসবে। ঘটনার ক্ষেত্র, গতি, ভয়াবহতা ও লক্ষণ বিচারে কারণ কিছুটা অনুমান করা যায়।গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বা বৈদ্যুতিক অগ্নিকাণ্ড এবং পরবর্তী সময়ে কেমিক্যাল রেপিড এক্সপ্লোশনই এ দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে হয়তো কাজ করেছে। ভবনগুলোতে উপযুক্ত বা বিকল্প নির্গমন পথ থাকলে প্রাণহানির পরিমাণ হ্রাস পেত।

    বনানীর এফআর টাওয়ারের দুর্ঘটনাটির সূত্রপাত বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে। সেলুলোজিক ফায়ারের কিছু লক্ষণও অনুমেয় হয়েছে। গতি তুলনামূলকভাবে অনেকটা মন্থর হলেও প্রাণহানি ঠিকই ঘটেছে ২৬ জনের। কারণ অনেকটাই স্পষ্ট।ভবনটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। উপরের তলাগুলো থেকে অনেককেই প্রাণ বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে ক্যাবল বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে দেখা গেছে। কর্মজীবী মানুষের বাঁচার কী চেষ্টা! এভাবে নামতে যেয়ে আবার কেউ কেউ থেঁতলে গেছেন ওপর থেকে পড়ে। কী মর্মান্তিক কষ্টের সে দৃশ্য! সঠিক নির্গমন পথ থাকলে অনেকের পক্ষেই নিরাপদে বেরিয়ে আসা সম্ভব হতো।

    গুলশানের ডিএনসিসির কাঁচাবাজারের অগ্নিকাণ্ডে কেমিক্যাল একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। এখানে ২০১৭ সালেও একবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। কমিটির সুপারিশ ও নির্দেশনা ছিল। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে হয়তো আজ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতো।ঘটে যাওয়া প্রতিটি দুর্ঘটনার কারণ কারিগরি। সমাধানও কারিগরি। প্রয়োজনীয় করণীয়গুলোও আমাদের জানা। বিপত্তি সেই এক জায়গাতেই, ব্যবস্থা না নেয়া। সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করা। কিছুদিন ভাবা ও কৌশলে সুবিধামতো সব এড়িয়ে যাওয়া। আমরা এতেই যেন ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।

    ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর ভূমিকা রেখেছে। বনানীতে সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী। সবার আন্তরিকতা ও চেষ্টা ছিল সুস্পষ্ট। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়ার চেয়ে কিছু সময় নিয়ে পরিস্থিতি ভালোভাবে জেনে সঠিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে কাজ শুরু করা অধিকতর শ্রেয়।বনানীর দুর্ঘটনায় ফায়ারের মাত্রা ও গতি তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল। তথাপি ২৬ জনের প্রাণহানি। আটকে পড়াদের উদ্ধার করতে এফআর টাওয়ারের পাশাপাশি ভবন দুটি ভালোভাবে ব্যবহার করা যেত। ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর দুটি টিম শুরু থেকে ভবন দুটিতে ঢুকে উপযুক্ত স্থানে অভ্যন্তরীণ দেয়াল ভেঙে বিকল্প নির্গমন পথ তৈরি করতে পারত।

    ঘটে যাওয়া প্রতিটি দুর্ঘটনায় বিশেষ করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বাহিনীর কর্মপরিকল্পনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। চুড়িহাট্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ইতিবাচক ছিল। তবে বনানীতে জনতার ভিড় নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল বলে জানা যায়, যা দুঃখজনক। এ বিষয় আমাদের জাতীয়ভাবে নতুন কিছু ভাবার সুযোগ রয়েছে।২০১৮ সালে জার্মান সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জার্মানিতে একটি উচ্চতর প্রশিক্ষণে আমার অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আমরা ২৪ জন প্রশিক্ষণে ছিলাম।

    সবাই অভিজ্ঞ ও নিজ নিজ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের। আমাদের জার্মান স্টেট অফ আর্ট টেকনোলজি অ্যান্ড প্র্যাকটিস জানানোই ছিল প্রশিক্ষণের অন্যতম লক্ষ্য। প্রশিক্ষণের তৃতীয় দিনে আমরা পরিদর্শন করি একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। বিষয়ভিত্তিক কাজ শেষে ফিরে আসার পথে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে, যার কার্যক্রম অনেকের কাছেই নতুন।জার্মানিতে প্রতিষ্ঠানটির নাম টিএইচডব্লিও, ফেডারেল এজেন্সি ফর টেকনিক্যাল রিলিফ। জার্মান কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হল কারিগরি সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে জনসাধারণকে বিপর্যয় বা জরুরি অবস্থা থেকে রক্ষা করা।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রণালয়ের আদেশে টিএইচডব্লিও প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের পরিস্থিতিতে জার্মান নাগরিকদের সহায়তা করাই ছিল তখনকার মূল উদ্দেশ্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে প্রতিষ্ঠানটিতে।বর্তমানে যে কোনো বিপর্যয় বা জরুরি অবস্থায় কারিগরি সহায়তা দেয়াই হচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানের কাজ। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে রয়েছে ২টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ৮টি আঞ্চলিক দফতর, ৬৬টি শাখা দফতর ও ৬৬৮টি স্থানীয় দফতর। বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৭৯৫১৪ জন, যার ৯৯ শতাংশই স্বেচ্ছাসেবক।

    কারিগরি বিষয়ে যথাযথ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জার্মান নাগরিক নির্ধারিত যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে টিএইচডব্লিও সদস্য হয়ে থাকে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সসহ অন্য সব নিয়মিত বাহিনীও জার্মানিতে রয়েছে।বিপর্যয়কালীন নিয়মিত বাহিনীগুলোই প্রথমে কাজ শুরু করে। বিশেষ কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন হলে নিয়মিত বাহিনীগুলো তাদের প্রয়োজন জার্মান কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে জানায়।

    পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনায় টিএইচডব্লিও সংশ্লিষ্ট টিম কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে। টিএইচডব্লিও কেন্দ্রীয় সরকারের একটি টেকনিক্যাল রিজার্ভ ফোর্স। যার পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য তেমন ব্যয় নেই, কেননা এখানে সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে থাকে।টিএইচডব্লিও শাখা দফতরে আমাদের আসা হল। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্তর থেকে একজন করে মোট তিনজন ছিলেন আমাদের জন্য। জনশক্তি ও সময়ের সঠিক ব্যবহারে যেন সবাই পাকা। প্রথমজন ছিল মাঝবয়সী এক তরুণী। টিএইচডব্লিও কার্যক্রম সংক্ষেপে উপস্থাপন করলেন।সঙ্গে সঙ্গে চলল আমাদের চা-কফি। জানালেন সে স্বেচ্ছাসেবী সদস্য হিসেবে প্রথমে শুরু করলেও স্টাফ হিসেবে এখন কর্মরত আছেন। দ্বিতীয়জনও মাঝবয়সী তরুণী। জানালেন, পাম্পসহ আরও ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্র পরিচালনায় সে অভিজ্ঞ।

    শেষজন ছিলেন তুলনামূলকভাবে বয়স্ক। আলাদা ইউনিফর্ম পরা। জানালেন, আন্তর্জাতিক মিশনেও অংশগ্রহণ করেছেন। সে পানি পরিশোধন টেকনোলজিস্ট। পানি পরিশোধন বিষয়টি আমার জানা ছিল। তাই তার কাজটি একটু বিস্তারিত জানতে চাইলাম।লোকটি বিনয়ের সঙ্গে পানির গুণগতমান পরীক্ষণ প্যারামিটার, পরিশোধন প্রক্রিয়া, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রপাতির ক্যালিব্রেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি জানালেন। ঘুরে ঘুরে দেখতে পেলাম, নানা রকমের প্রয়োজনীয় কারিগরি যন্ত্রপাতিতে সুসজ্জিত টিএইচডব্লিও কার।

    যন্ত্রপাতিগুলোর অনেক কিছুই বিনামূল্যে এসে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। টিএইচডব্লিও প্রশ্নে সবার মাঝে এক ধরনের তৃপ্তি ও প্রশান্তি ছায়া লক্ষ করলাম। জানতে চাইলাম, তারা কেন টিএইচডব্লিওতে আছেন। জানালেন, পেশাগত ভূমিকার বাইরেও দেশ ও দশের জন্য কাজ করতে তারা টিএইচডব্লিওতে আছেন।আমাদের জনসাধারণকেও পরিকল্পিতভাবে বিপর্যয় মোকাবেলায় কাজে লাগানো যেতে পারে। কারিগরিভাবে দক্ষ ও অভিজ্ঞদের জার্মান টিএইচডব্লিও বা ভিন্নভাবে সংগঠিত করে নিয়মিত বাহিনীর সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। প্রয়োজন শুধু সরকারের একটি উদ্যোগ।

    পরিশেষে বলব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অবকাঠামো হোক, সব ক্ষেত্রেই জননিরাপত্তার বিষয়টি এদেশে বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। যদি বাঁচতেই না পারি, বাকি সব দিয়ে কী লাভ আমাদের?


    ড. ইকবাল হোসেন : শিক্ষক, কেমিকৌশল বিভাগ, বুয়েট

    No comments

    If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.

    পৃষ্ঠা

    সর্বশেষ খবর

    COVID-19 থেকে বাঁচার উপায় !