পরীক্ষা কেন্দ্রে দগ্ধ সেই ছাত্রী লাইফসাপোর্টে
ফেনীর সোনাগাজীতে পরীক্ষাকেন্দ্রে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে দগ্ধ সেই শিক্ষার্থীর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। তাকে লাইফসাপোর্টে নেয়া হয়েছে বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।সোমবার বেলা ১২টার দিকে ওই ছাত্রীকে বার্ন ইউনিটের লাইফসাপোর্টে নেয়া হয়।
সোমবার সকালে সেই ছাত্রীকে দেখে এসে ডা. সামন্ত লাল সেন গণমাধ্যমকে বলেন, ওই ছাত্রীর অবস্থা ভালো নয়। গত দিনের চেয়ে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।ওই ছাত্রীর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড জানিয়েছে, ওই ছাত্রীর অবস্থা গুরুতর। যেকোনো সময় পরিস্থিতি যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে।তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। মানুষের শরীরে চামড়ায় ৭টি লেয়ার থাকে, ওই ছাত্রীর সব লেয়ার পুড়ে গেছে। শ্বাসনালিও পুড়ে গেছে। পাশাপাশি দগ্ধ হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তাকে বার্ন ইউনিটে আনা হয়নি, সময়ক্ষেপণ হয়েছে। এতেও তার অবস্থার অবনতি হয়েছে।
এর আগে রোববার সকালে বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল যুগান্তরকে বলেন, তার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। শরীরের তিন-চতুর্থাংশ পুড়ে গেছে। শ্বাসনালিও পুড়ে গেছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।এদিন ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘মেয়েটির শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার অবস্থা ক্রিটিক্যাল। তার ব্যাপারে চিকিৎসকরা এখনও কিছু বলতে পারছেন না। মেয়েটির চিকিৎসা চলছে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।’ এর আগে রোববার ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী ওই ছাত্রীর সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছেন। ছাত্রীর চিকিৎসা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। তার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।’
এদিকে ওই ছাত্রীর চিকিৎসায় রোববার সকালে ৮ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, মেডিকেল বোর্ডের মতামতের ভিত্তিতে তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। মেডিকেল বোর্ডে রয়েছেন- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক আবুল কালাম, অধ্যাপক রায়হানা আউয়াল সুমি, অধ্যাপক নওয়াজেস খান, অধ্যাপক লুৎফর কাদের লেলিন, অধ্যাপক বিধান সরকার, অধ্যাপক মহিউদ্দিন আহমদ, ডা. নজরুল ইসলাম ও ডা. জাহাঙ্গীর কবির।
চিকিৎসার বিষয়ে মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক আবুল কালাম রোববার জানান, বোর্ডের সদস্যরা আইসিইউতে গিয়ে দু’বার পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার গলা থেকে শরীর, দুই হাত, পা- সব জায়গায় পুড়ে গেছে। পাশাপাশি তার শ্বাসনালিও পুড়ে গেছে। অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলে দু-একদিনের মধ্যেই অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত ফেনীর সোনাগাজীতে পরীক্ষাকেন্দ্রের ভেতর ওই ছাত্রীর (১৮) গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যাচেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। শনিবার সকালে সোনাগাজী পৌর এলাকার ইসলামিয়া সিনিয়ার ফাজিল মাদ্রাসাকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। ওই ছাত্রী ওই মাদ্রাসা থেকেই আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন।
পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত কক্ষ থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে কয়েকজন বোরকা পরা নারী পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ করেছেন ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা। তারা জানান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে দায়ের করা মামলা তুলে না নেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ তথ্য ফেনী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় পুলিশকেও জানিয়েছেন ওই শিক্ষার্থী। তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় এদিন বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ১০২ নম্বর কক্ষে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ওই ছাত্রীর মা। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে অধ্যক্ষ তার অফিসের পিয়ন নূরুল আমিনের মাধ্যমে ছাত্রীকে ডেকে নেন। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ।পরে পরিবারের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন অধ্যক্ষ। সেই মামলা তুলে না নেয়ায় অধ্যক্ষের লোকজন ওই ছাত্রীর গায়ে আগুন দিয়েছে।
এদিকে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিকেএম এনামুল করিমের সভাপতিত্বে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার গভর্নিং কমিটির সভায় রোববার এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া সভায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকদের পক্ষ থেকে অগ্নিদগ্ধ ছাত্রীর চিকিৎসায় দুই লাখ টাকা অনুদান দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।
সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে শিশু বলাৎকারের ঘটনায় ফেনী সদরের একটি মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে নাশকতা, যৌন হয়রানি ও চেক জালিয়াতিসহ ফেনী এবং সোনাগাজী মডেল থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে মাদ্রাসার একজন শিক্ষক ও এক ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আটক করা হয়েছে।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.