অর্কিড চাষে পাহাড়ে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
পাহাড়ে বাড়ছে ভালোবাসা, আভিজাত্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক অর্কিড চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। অর্কিড ফুল চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং গাছ-ফুল রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও ব্যাপক সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায়।এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্কিড সংরক্ষণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে অনেকে।কৃষি বিভাগ ও অর্কিড বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের আবহাওয়া অর্কিড চাষের বেশ উপযোগী। দেশের মধ্যে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি তিন পার্বত্য জেলায় এবং সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে অর্কিড পাওয়া যায়।
তবে পাহাড়ে অপরিকল্পিত জুম চাষ, বনাঞ্চল উজাড় ও পরিবেশ ধংসের কারণে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান অর্কিড।বিশ্বে বর্তমানে ৩০ হাজারের বেশি প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। তার মধ্যে ক্রাইটোক্সাম, ডেন ফার্মেরি, ডেন অ্যাগ্রাগেটাম, ডেন ক্রিপিডেটাম, পিয়ারেড্ডী, ডেন প্রিমুলিনাম, বাল্বোফাইলামসহ প্রায় ৪৯ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে বান্দরবানে শিক্ষক আমির হোসেন নয়নের অর্কিড সংরক্ষণ শালায়।
২০১৬ সালে শখের বসে বাড়ির আঙিনায় গড়ে তোলা অর্কিড বাগানটি বর্তমানে অর্কিড সংরক্ষণশালায় পরিণত হয়েছে। জেলা শহরের কালাঘাটা ফ্রেন্সিঘোনায় ছয় শতক জমিতে গড়ে তোলা অর্কিড বাগানটির মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলে অর্কিডের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
প্রতিদিনই অর্কিডপ্রেমী শিক্ষকের ছোট্টপরিসরে গড়ে তোলা অর্কিড বাগান দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন লোকজনরা। ঘুরে দেখার পর কিনে নিয়ে যাচ্ছে অর্কিডগাছও। শিক্ষকের দেখাদেখি আরও অনেকে বাড়ির আঙিনায় ও ছাদে অর্কিডের চাষ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।দর্শনার্থী ছাদ বাগান চাষি ফাতেমা বিনতে আলম ও চিনো দেওয়ান বলেন, আকর্ষণীয় রঙ, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, ঔষধি গুণাগুণ, সুগন্ধি, দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল বৈশিষ্টগুলোর কারণে অর্কিডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে বাংলাদেশেও।আমাদের ছাদ বাগানেও বিভিন্ন ধরনের ফলফুলের গাছ রয়েছে। কিন্তু অর্কিডের সংখ্যাটা খুবই কম। ফেসবুক পেজের অর্কিড বাগানটির খবর পেয়ে দেখতে এলাম। ছোট্টপরিসরে হলেও সংরক্ষণশালা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তাই নিজেদের বাগানের জন্য কিছু অর্কিড গাছ সংগ্রহ করলাম। অর্কিড চাষ সম্পর্কে কিছুটা ধারণাও নিলাম।
অর্কিড বাগান চাষি শিক্ষক আমির হোসেন নয়ন বলেন, জুম চাষ, বনাঞ্চল উজাড়সহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান অর্কিড। পাহাড়ের মানুষেরা অর্কিড সম্পর্কে সচেতন নয়, পরগাছা আর আগাছা ভেবে মূল্যবান অর্কিডগুলো নষ্ট করে ফেলছে। অর্কিডের প্রতি দুর্বলতা থেকে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে বিভিন্ন স্থান থেকে অর্কিড সংগ্রহ করে নিয়ে আসতাম।
পরে বাড়ির আঙিনায় টবে ও গাছের ঢালে লাগিয়ে পরিচর্যা করতাম। উৎসাহ দেখে আমার স্ত্রী ও দুই সন্তান অর্কিড সংরক্ষণে আমায় সহযোগিতা করেছে। মূলত তাদের সহযোগিতায় ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৯ সাল মাত্র দুবছরে অর্কিড বাগানটি দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চাহিদা তৈরি হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে অর্কিড চাষের সম্ভাবনাও বেড়েছে পাহাড়ে। এখন দেশেও অর্কিড ফুলগাছ সংগ্রহ ও রফতানি করা হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে গাছের ছবি এবং ফুল দেখে পাহাড়ের অর্কিড বাগান থেকে অর্কিড সংগ্রহে যোগাযোগ করছে বিদেশি অর্কিড চাষিরাও। আমি নিজেও মিয়ানমার ও ভারতের মিজোরাম থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্কিডগাছ সংগ্রহ করেছি।
এ ছাড়া দেশের মধ্যেও বাড়ির ছাদ, বারান্দা ও ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ভালোবাসা, আভিজাত্য এবং সৌন্দর্যের প্রতীক অর্কিড ফুলগাছ সংরক্ষণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে মানুষেরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করে বান্দরবানের অকির্ড বাগান থেকে কুরিয়ারে অর্কিড ফুলগাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন আগ্রহীরা।
বাগানের পরিসর বাড়াতে এবং খরচ মেটাতে চাহিদা অনুপাতে আগ্রহীদের কিছু কিছু অর্কিডগাছ বিক্রি করা হচ্ছে। বাগানে ৪৯ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে। প্রায় তিন লাখ টাকা বিক্রি করেছি এ পর্যন্ত। অর্কিড চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গাছ-ফুল বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা।অর্কিডচাষি মনোয়ারা রুবি বলেন, মাত্র ছয় শতক জমিতে স্বামীর প্রচেষ্টায় ছোট্টপরিসরে অর্কিড বাগানটি গড়ে তোলা সম্ভব হয়। স্বামী সরকারি স্কুলের একজন শিক্ষক হওয়ায় শুক্রবার ছাড়া অন্যান্য দিন বাগানে সময় দিতে পারেন না। তাকে (স্বামীকে) সহযোগিতা করতে অর্কিড বাগানের প্রতি তারও ভালোলাগা জন্মায়। গাছে নিয়মিত পানি দেয়া ও স্প্রে করাসহ রক্ষণাবেক্ষণের কাজগুলো তিনিই করেন।
বাগানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কর্মচারীও রয়েছে। প্রতিদিনই বাগানটি দেখতে ভিড় জমায় লোকজনরা।এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মো. আলতাফ হোসেন বলেন, বর্তমানে বিশ্বে কয়েক হাজার কোটি ডলারের অর্কিড বাণিজ্য হয়, যার মধ্যে সিংহভাগ দখল করে আছে থাইল্যান্ড। এ জন্য থাইল্যান্ডকে অর্কিডের রানি বলা হয়। জাতভেদে সারা বছরই অর্কিডের ফুল ফোটে। তবে মার্চ ও মে মাসে দেশীয় অর্কিড সর্বাধিক পাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু অর্কিড বছরে দু-তিনবার ফোটে।
প্রতিটি গাছে জাতভেদে দু-চারটি স্টিক পাওয়া যায়। দেশের মধ্যে পাহাড়ে অর্কিড চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শিক্ষক নয়নের মতো আরও অনেকে এগিয়ে এসেছে অর্কিড চাষে। বাণিজ্যিকভাবে অর্কিড চাষ করা গেলে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থান তৈরি এবং বিদেশে অর্কিড রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব হবে।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.