রাজধানীতে ১ লাখ ৭৮ হাজার চলমান বোমা
রাজধানী ঢাকায় সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৯২৭টি সিএনজিচালিত যানবাহন, যেগুলোর গ্যাসভর্তি সিলিন্ডারের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরও পরীক্ষা করা হয়নি। বিস্ফোরক পরিদফতর ও রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল) কর্মকর্তারা বলছেন, এসব সিলিন্ডারের মধ্যে কোনোটিতে ত্রুটি তৈরি হয়ে থাকলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরীক্ষিত সিলিন্ডার নিয়ে চলমান এসব যানবাহন আসলে একেকটি ‘চলমান বোমা’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৮৮৪ সালের বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারকে ‘বোমা’ হিসেবে বিবেচনা করে পরিবেশ অধিদফতর। সে কারণে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে পাঁচ বছর পর পর সিলিন্ডারগুলো পরীক্ষণের নীতিমালা রয়েছে। ৩ হাজার পিএসআই প্রেশার বা গ্যাসের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা সিলিন্ডারের আছে কিনা সে বিষয়টি পাঁচ বছর পর পর পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশনা রয়েছে আন্তর্জাতিক রীতিতে। বাংলাদেশেও ২০০৫ সালে যে সিএনজি বিধিমালা করা হয়, সেখানে পাঁচ বছর পর পর সিএনজিচালিত যানবাহনের সিলিন্ডার পরীক্ষার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরীক্ষায় ত্রুটি ধরা পড়লে নতুন সিলিন্ডার বসাতে হবে। তবে গাড়ির মালিক ও চালকদের উদাসীনতায় বছরের পর বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার নিয়েই চলছে প্রায় পৌনে ২ লাখ যানবাহন। বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও অপরীক্ষিত সিলিন্ডার নিয়ে যেসব গাড়ি চলমান রয়েছে বা যারা চালাচ্ছেন, তারা নিজেরাই রয়েছেন মৃত্যুঝুঁকিতে। ছোট গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে চালক ও ভিতরের যাত্রী হতাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বড় গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আশপাশের লোকজনেরও ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ বিষয়ে আমরা বিআরটিএকে বার বার বলেছি, যাতে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার আগে সিলিন্ডারের মেয়াদের বিষয়টি যাচাই করা হয়।’ আরপিজিসিএলের হিসাব অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত সারা দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৩ হাজার ১৩১টি। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৫০৬টি যানবাহন সিএনজি ব্যবহারের জন্য রূপান্তরিত। ১ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি অটোরিকশা ও ৪০ হাজার ৩৮৩টি বাহন গ্যাসচালিত হিসেবে আমদানি করা হয়েছে। ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত যেসব বাহন রূপান্তরিত এবং নিবন্ধিত হয়েছে, বিধিমালা অনুযায়ী সেগুলোর সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর জুনে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৯টি সিএনজিচালিত যানবাহন নিবন্ধিত হয়। এর মধ্যে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪৭৯টি বাহনের সিলিন্ডার গত অক্টোবর পর্যন্ত অপরীক্ষিত ছিল। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সে সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। তবে এর মধ্যে কিছু গাড়ির সিলিন্ডার রিটেস্ট বা পুনঃপরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আরপিজিসিএলের ডিজিএম (পিঅ্যান্ডএম) প্রকৌশলী খালেদা বেগম বলেন, ‘বিভিন্ন ওয়ার্কশপ থেকে আমরা গাড়ির সিলিন্ডার রি-টেস্টিংয়ের যে তথ্য পাই, সেটিই মন্ত্রণালয়ে পাঠাই । ওই তথ্যানুযায়ী এপ্রিল, ২০১৯ শেষে মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি কনভারশন গাড়ির সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ৯২ হাজার ৬৭৬টি গাড়ির সিলিন্ডার রি-টেস্ট করা হয়েছে। বাকিগুলো অপরীক্ষিত অবস্থায় চলছে। ওই তথ্যানুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার নিয়ে চলছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৯২৭টি গাড়ি।’ ২০০৫ সাল থেকে যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনার তথ্য সংরক্ষণ করছে আরপিজিসিএল। সেখানে দেখা যায়, সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ২০০৫ সালে দুটি, ২০০৬ সালে সাতটি, ২০০৭ সালে সাতটি, ২০০৮ সালে আটটি, ২০০৯ সালে পাঁচটি, ২০১০ সালে পাঁচটি, ২০১১ সালে ছয়টি, ২০১২ সালে পাঁচটি, ২০১৪ সালে ১০টি, ২০১৬ সালে চারটি এবং ২০১৭ সালে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই টাঙ্গাইলে একটি মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিনজনের মৃত্যু হয়। একই বছরের ৩ জুন নোয়াখালীতে একটি অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজন মারা যান। আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মহম্মদ আলী বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বৈধ বা অনুমোদিত কনভারশন সেন্টারের মাধ্যমে যেসব গাড়ির সিলিন্ডার রিফুয়েলিং করা হয়, সেগুলো নিরাপদ। সেসব সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে না। এজন্য আমরা বিআরটিএকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় অন্যান্য যন্ত্রাংশের পাশাপাশি গাড়ির সিলিন্ডার বৈধ কনভারশন সেন্টার থেকে রিফুয়েলিং করা হয়েছে কি না, মেয়াদ শেষে রি-টেস্টিং করা হয়েছে কি না- এসব বিষয় যাচাই করে পরে সার্টিফিকেট দেয়। ভুয়া সনদ দেখিয়ে যাতে ফিটনেস না নিতে পারে বিআরটিএকে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.