নতুন ভ্যাট আইন প্রস্তুতি ছাড়া বাস্তবায়নে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলছে, প্রস্তুতি ও মূল্যায়ন ছাড়া এ আইন বাস্তবায়ন হলে মূল্যস্ফীতি হতে পারে, যা সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। যদিও শনিবার এনবিআরে বাজেট প্রস্তুতিমূলক বৈঠকের আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ব্যবসায়ীরা যেভাবে চাচ্ছেন, সেভাবেই এ আইন বাস্তবায়ন হবে।
৫ মে এফবিসিসিআই নতুন ভ্যাট আইনের বেশকিছু বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে। একই সঙ্গে ভ্যাট আইন বিষয়ে গত ২ বছরে ফলপ্রসূ আলোচনা না হওয়ায় ‘হতাশা’ ব্যক্ত করেছে সংগঠনটি।চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের জুনে পুনর্মূল্যায়নের জন্য ২ বছরের জন্য আইনটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু এ সময়ে আইন সংশোধনের বিষয়ে এনবিআরের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। ২০১৭ সাল থেকেই আইনের ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করার বিষয়ে আহ্বান জানানো হয়। সর্বশেষ গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সময় স্বল্পতার জন্য ‘কস্ট বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ করতে এফবিসিসিআই থেকে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়। এছাড়া গত ২ বছরে এফবিসিসিআই ও এনবিআরের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে আইনে যেসব বিষয়ে সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলো সংশোধিত আইনে প্রতিফলন ঘটেনি।
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘এফবিসিসিআই আশঙ্কা করছে, অপ্রস্তুত ও মূল্যায়ন ছাড়া নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যেতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে, যা গণমানুষের বিপক্ষে যাবে এবং সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। বাণিজ্য সহজীকরণ এবং রাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন করা হলে জনগণের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভ্যাটের একাধিক রেট সংবলিত পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে রেয়াতি সুবিধা না দিলে ওইসব পণ্যের দাম বাড়বে।’
এদিকে শনিবার এনবিআরে বাজেট প্রস্তুতিমূলক সভায় অংশ নেয়ার আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ইচ্ছা থাকলেও তা করতে দেয়া হয়নি। তবে আগামী বাজেটে আইনটি পুরোপুরি কার্যকর হবে। আগে একক ভ্যাট হার থাকায় ব্যবসায়ীদের আপত্তি ছিল। তখন আইন পরিবর্তন করা যায়নি, বাজেটও ছিল না। এখন ব্যবসায়ীরা যেভাবে চাচ্ছেন, সেভাবেই হবে। আইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হবে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশ এক বছরে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আমরা এ বছর থেকে বাস্তবায়ন শুরু করব।
এনবিআরের কাছে দেয়া এফবিসিসিআই’র ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের যে কোনো আইন বা নীতিমালা ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করা সমীচীন। এই ভিশনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ কোনো আইন বা নীতিমালা বাস্তবায়ন বেসরকারি খাত কোনোভাবেই সমর্থন করে না। এফবিসিসিআই ২০১২ সাল থেকেই বলছে, নতুন ভ্যাট আইন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয়।নতুন ভ্যাট আইনে কর্মকর্তাদের ইনসেনটিভের প্রস্তাব রাখার কঠোর সমোলচনা করে এফবিসিসিআই’র চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য ইনসেনটিভ বোনাসের কথা বলা হয়েছে। এটি অনিয়মকে উৎসাহিত করবে এবং দুর্নীতি বাড়াবে। কর্মকর্তাদের আয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করবে।
আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে- এমন মন্তব্য করে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২ মে এনবিআরে আইনের সংশোধন ও বাস্তবায়নের বিষয়ে একটি সভার নোটিশ দেয়া হলেও সভাটি অনুষ্ঠিত হয়নি। সভার নোটিশ দিয়ে সভার আয়োজন না করা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। সেই সঙ্গে গত ২ বছরে অনুষ্ঠিত সভাগুলোর সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত না হওয়ায় স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ উপেক্ষা করার শামিল।জানতে চাইলে এফবিসিসিআই’র নবনির্বাচিত সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম যুগান্তরকে বলেন, বাজেটের আগে নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের কিছু উদ্বেগ আছে, সেগুলো এনবিআরকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। আশা করছি, এসব সমস্যা সমাধানে বাজেটের আগেই এনবিআর-এফবিসিসিআই ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে।
প্রবৃদ্ধির সংশয় ঠিক নয় -অর্থমন্ত্রী : বৃহস্পতিবার ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম। সেখানে প্রবৃদ্ধি হার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি যেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভালো খবর দিচ্ছে, সেখানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের এমন সংশয় ঠিক নয়। আইএমএফ’র একটি প্রক্ষেপণ তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা সংকট থাকলেও ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিন দশমিক ছয় শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ২০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এ তালিকায় অন্য দেশগুলোর মধ্যে আছে স্পেন, কানাডা ও থাইল্যান্ড। এসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ওই দেশগুলোয় ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয় আর বাংলাদেশে হয় পয়েন্ট ৯ শতাংশ হারে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, কর আহরণের ক্ষেত্রে আগামী দিনে নতুন ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করবে এনবিআর। কর জিডিপি অনুযায়ী রাজস্ব আদায় কম হলেও দেশের প্রবৃদ্ধি কমবে না বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির বড় এলাকা হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। এটি সরকারের তৈরি করা না। এনবিআরকে ঘিরে নানামুখী সংস্কার উদ্যোগের কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী জানান, আগে যেসব জায়গায় আমরা হাত দেইনি, এখন সেখানে হাত দেয়া হবে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, বাড়ানো হবে এনবিআরের জনবল।
গেল ১০ বছরে রাজস্ব আদায়ের যে গতি, তাতে সন্তোষ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর এবারের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। রাজস্বের এই লক্ষ্য পূরণ না হলেও কাছাকাছি পর্যায়ে যাবে। এছাড়া এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব আহরণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। মূলত এপ্রিল-মে মাসেই বেশি রাজস্ব আহরণ হয়। সেই তথ্য পাওয়া যায় পরে।
সূত্র- যুগান্তর
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.