|| বেশ্যা ||
® রোহিত রায়
১ম প্যারা :
পূজোর পর রন্টি মেসে এসে দেখল যে তাকে একাই থাকতে হবে এখন । কারণ মেসের বাকিদের আসতে আরোও দিন দুয়েক বাকি । এই হয়েছে এক মুশকিল !! এরা আজ অবধি কোনোদিন মেসে ঠিক সময়ে এসে পৌঁছায়নি , হয় পরেরদিন নয়তো সেদিন মাঝ রাতে । ঘটা করে আবার স্টেশনে নামার আগে ফোনে মাঝ রাতে বলে , "শোনরে আমি আর দশ মিনিটের মধ্যেই ঢুকছি স্টেশন , তুই সাইকেল নিয়ে চলে আয় " । কাঁচা ঘুম থেকে উঠে এমন অর্ডার শুনতে কার ভালো লাগে ??? দিতো বাসি মুখেই কয়েকটা কাঁচা কাঁচা খিস্তি । শালাগুলো এত শয়তান, খিস্তি শুনে খুশি হয়ে বলে, "এইতো তোর শরীর ঠিক-ই আছে , চলে আয় স্টেশন "।
২য় প্যারা :
জামা-প্যান্ট ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিল । রাস্তায় যে হারে ধুলো হজম করতে হয়েছে, চুলগুলো সব পাটের মত খস-খস করছে । চান করে এসে হোটেলের রতন দা-কে ফোন করে বলে দিল খাবারের কথা । ইউনিভার্সিটি খোলার কথা ছিল আজ কিন্তু কাল খুলবে তাই আজ সারাদিন হাতে সময় পেয়েছে । ভাবলো রুমটা পরিষ্কার করে নিক । দুপুরে খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে রুমটা পরিষ্কার করা শুরু করল । গোটা রুম ঝাঁট দিয়ে পাওয়া গেল একগাদা বিড়ি-সিগারেটের পিছন, মদের বোতলের ঢাকনা, আর ওসবের-ই খালি প্যাকেট । পুরো ঘরটা অ্যাশ ট্রে করে দিয়েছে । এখন রুমটাকে দেখে একটু পদের বলে মনে হচ্ছে । আবার চান করতে হল রন্টিকে বাধ্য হয়ে । সন্ধ্যায় বেরোলো এদিক-ওদিক ঘোরার জন্য । সারাদিন রুমেই কেটে গেল তাই একটু মুক্ত বাতাসে আপন খেয়ালে সময় পাস করার জন্য বাইরে বেরোলো । সন্ধ্যার দুর্গাপুর অনেক দিন দেখা হয়নি ওর । দিকভ্রান্ত পথিকের মত যেদিকে ইচ্ছে করল সেদিকেই গেল । এভাবে সময়টা কাটিয়ে রাত ঐ ৯টার দিকে রতনদা-র হোটেলে খেয়ে মেসে ফিরে এল।
৩য় প্যারা :
শুয়েছে কিন্তু ঘুম আসছেনা । সাধারণত এমন হয়না, শুলেই ঘুমিয়ে যায় রন্টি । এজন্য মেসে সবাই ওকে এক বিশেষ নামে ডাকে । আজ কি হল কে জানে ? অনেক চেষ্টা করল নিদ্রা দেবীকে নিজের কাঁধে ভর করানোর কিন্তু হচ্ছে না ।নিদ্রা দেবী মনে হচ্ছে আজ প্রশন্ন নয় । কি আর করবে !!! লটপট(সরি ল্যাপটপ্)- টা খুলে বসল । কি মুভি দেখবে সেটা খুঁজতে খুঁজতে নজরে এল বাংলা মুভি "রাজকাহিনী" । সেইমতো দেখা শুরু করল রন্টি । পুরোটা দেখা যখন শেষ হল তখন বাজছে প্রায় দু-টো । এবার শুয়ে পড়ল । পুরো মুভিটা একটানা দেখেছে সে । এবার মনে হচ্ছে ঘুম এসে যাবে । হ্যাঁ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম এসে গেল ।
৪র্থ প্যারা:
সকালে উঠে ব্রাশ করতে করতে হঠাৎ মাথায় ক্লিক করল যে সেও একবার বেশ্যালয় যাবে । নিজেই ব্রাশ করা থামিয়ে একবার ভাবল- ঠিক হল কিনা ভাবাটা । হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে । ভালো সুযোগ, কেউ নেই এখন মেসে । কেউ জানতেও পারবে না । ব্যাস ব্যাস... যেমনি ভাবা অমনি কাজ । বেশ্যালয় সম্বন্ধে অনেক কথা কানাঘুঁসো শুনেছে সে কিন্তু যায়নি কখোনো । আজ যাবার ইচ্ছে হল । শুনেছে রেট-ফেট-এরও নাকি ব্যাপার থাকে তারপর নাকি লোক দেখে দর হাঁকে ওরা আবার এটাও শুনেছে নতুন মেয়েদের নাকি রেট বেশি । এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ঠিক-ই করে ফেলল যাবে । সাথে থাকবে জমানো দু-হাজার টাকা । টিউশন পরিয়ে জমিয়েছে সেই টাকাগুলো ।
৫ম প্যারা :
তাড়াতাড়ি রতনদা-র দোকানে খেয়ে বেড়িয়ে পড়ল । বেশিদূর যেতে হবে না, দুর্গাপুরেই তো আছে - কাদারোড । বিধান নগর থেকে বাস ধরে নিল রন্টি । এতক্ষণ মনে সাহস নিয়ে ছিল কিন্তু যেই কাছাকাছি পৌঁছালো ওমনি ওর বুকটা ধুক-পুক করতে লাগল । যতোই হোক এসব জায়গায় সাধারণ লোক আসেনা । এসব জায়গাগুলোর নাম শুনলেই নাক-মুখ কুঁচকোয়, ভালো নজরে দেখে না তাই ওরও ভয় করতে লাগল । কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্ত করে "যো হোগা দেখা যায়েগা" বলে গলিতে ঢুকেই পড়ল ।
৬ট প্যারা :
ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ডাকাডাকি শুরু । রন্টি পরিষ্কার বুঝল যে ওকে সবাই লুফে নেবার জন্য ডাকছে, সে বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম কথা বলে ডাকছে । সে সুর কি ডাকার !!! বিভিন্ন বয়সের দাঁড়িয়ে আছে, বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে প্রায় মধ্যবয়সি অবধি । আড় চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিচ্ছে রন্টি । এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করল রন্টি, কম বয়সি মেয়েরা কিন্তু ডাকছে না তাদের হয়ে ছেলে-লোক ডাকছে । রন্টি বুঝল এরা নির্ঘাত দালাল । না বাবা থাক, দালালের চক্করে যেতে রাজি নয় রন্টি । এসব ভেবে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ নজর আটকে গেল একটা মেয়ের দিকে । মেয়েটা দরজায় হেলান দিয়ে চা খাচ্ছিল রাস্তার ধারে । মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল রন্টি । কাছে পৌঁছতেই এক মহিলা বলে উঠলেন , "কি যাবে নাকি ? 400 পার ঘন্টা" । "মানে ?? এক ঘন্টায় 400টাকা । বাপরে !!" - বলে উঠল রন্টি । হিসাব শুরু করল - 4×5=20, মানে পাঁচ ঘন্টা । নাহ্ ওই 1-2 ঘন্টাই যথেষ্ট । মানে 800টাকার গচ্ছা যাচ্ছে । ঠিক আছে যাক । রন্টি একটা হ্যাঁ সূচক তাকালো মহিলাটির দিকে । মহিলা বলে উঠলেন, "যা রে শর্মিলি, বৌলি টো করে লে" । রন্টি শুনে মনে মনে হাসল - "বৌনি" , এতেও নাকি বৌনি !! বাহঃ ভালো কথা ।
৭ম প্যারা :
রন্টি ঘরে ধুকল শর্মিলির পিছন পিছন । ঘরটা কেমন যেন ছোট্ট টাইপের । পুরো ঘিঙ্জি । ওখানেই আলমাড়ি আছে, টিভি আছে, বিছানা আছে আবার রান্নার জিনিস সব খাটের নিচে রাখা আছে । সত্যি !!! এই রুমটাই এদের সব । পুরো বাড়ি । অবাক হয়ে গেল রন্টি । মনে হয় চা-খাওয়াটা তখোনোও বাকি ছিল । শর্মিলি কাপটা টিভি-র পাশে রাখল । রন্টি জিজ্ঞাসা করল, "চা-টা কি খাওয়া বাকি আছে"? "ও ঠিক আছে, ওরকম দিনে কত চা নষ্ট হয়" । রন্টি শুনে বুঝল এর সকালের প্রথম চা-টাই রন্টির জন্য খাওয়া হল না তাই মেয়টার মেজাজ বিগড়ে গেছে । একেই তো কোনোদিন আসেনি এখানে তার উপর এমন এক মেয়ের পাল্লায় পড়ল যার মেজাজ গেছে ঘেঁটে । কি আর করে !!! শর্মিলি দরজা বন্ধ করে বলল, "কি করব ? আগে জামা-কাপড় খুলবো না আগে ড্রিংস করবে ?" "নাহ্ আমি ওসব করি না"- বলল রন্টি । শুনে "ন্যাকা চন্ডি" বলে বিড় বিড় করে উঠল শর্মিলি । এবার রন্টিরও রাগ হল, বলল-"অতো রাগের কি হল ?" "কিছু না" বলে শর্মিলি জামা কাপড় খুলে বিছানায় উঠল । রন্টির জামার বোতাম গুলো খুলে দিচ্ছিল শর্মিলি । বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল রন্টির । পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ছেড়ে রন্টি লেগে পড়ল বিছানার যুদ্ধে । জয়-পরাজয়ের ব্যাপারটা না-হয় গোপন-ই থাক ।
৮ম/অন্তিম প্যারা :
দুঘন্টার মধ্যে এখনো অনেক সময় বাকি আছে, ওরা বসে বসে গল্প করছে । করতে করতে রন্টি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, "তখন রেগে যাবার কারণ কি ছিল?" শর্মিলি বলল, "আমার মরদ এসেছিল ।" রন্টি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "তোমার বিয়ে হয়ে গেছে ?" "হমম্ বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করলাম একে । কয়েকদিন পর আমায় মার-ধর আরম্ভ করল । তারপর হঠাৎই একদিন আমায় এখানে বেচে দিল । শালা বিয়ের আগে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিল । এসে দেখলাম হারামী সব গল্প দিয়েছে । বাড়িতে বাপ-মা বহুবার মানা করেছিল । শুনিনি, ওদের মুখে মুতে দিয়ে পালিয়ে এসে একে বিয়ে করলাম । এখন ঘর যাবার রাস্তা বন্ধ । একটা বেশ্যাকে কে ঘরে ঢুকতে দেবে শুনি ? শালা কি না করিনি শয়তানটার জন্য । দিনে লোকের বাড়ি বাড়ি ঝি-এর কাজ করে, বিকেলে বিড়ির ফ্যাক্টরিতে কাজ করে পয়সা কামিয়ে সংসার সামলাতাম আর উনি...সেই টাকায় মদ খেয়ে ঘরে এসে আমাকেই মারত । সিগারেটের ছ্যাঁকা দিত, বেল্ট খুলে মারত । এসব মুখ বুজেই সহ্য করছিলাম ঘর যাবার রাস্তা নাই তাই । শেষে আরো পয়সার লোভে এখানে বেচে দিল । সপ্তাহে সপ্তাহে একবার করে দরদ দেখাতে চলে আসে যখন পয়সার দরকার হয় । শালা নাটক করে বলে- ঘর চল আমার সাথে, এখানে থাকতে হবে না । আমিও হারামীকে গাল দিয়ে হাতে টাকা ধরিয়ে ভাগাই ।"
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ হাঁ করে শর্মিলির দিকে তাকিয়ে থাকল রন্টি । এসব ঘটনা হয় এদের সাথে সেটা বিভিন্ন সিরিয়াল, সিনেমাতে দেখেছে কিন্তু এই প্রথম সামনা-সামনি কারো মুখে শুনল । এক বেখেয়ালে পড়ে গেল রন্টি, ভাবতে লাগল - নারীর বিভিন্ন রূপের মধ্যে বোধহয় এই 'শর্মিলি' রূপটাই কঠিন বাস্তবের নোংরা রূপ । প্রতিদিন তাকে কতো লাঞ্ছনারই না শিকার হতে হয় ! অনিচ্ছা সত্বেও তাকে বারবার অপরিচিত পুরুষের সাথে বিছানায় শুতে হয় অথচ এই সমাজ কখনো এদের সম্মান দেয়না আর সুদূর ভবিষ্যতেও হয়ত দেবে না । সত্যি কি এই সমস্ত ঘটনার পিছনে শর্মিলির মতো মেয়েদের কোন দোষ থাকে ? ও তো কাউকে বিশ্বাস করে নিজের সবকিছু ছেড়ে কারোর হাত ধরেছিল সেই ভুলের মাশুলটা এখন ওকে এভাবে দিতে হচ্ছে । সমাজ থেকে পুরো বঞ্চিত আজ শর্মিলিরা ।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ শর্মিলির ডাকে হুঁশ ফিরল রন্টির । নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "তার মানে সে একটু আগে এসেছিল তাই তোমার মেজাজ খিঁচলে আছে ?" " হুমম্ " - বলল শর্মিলি । রন্টি পুরো দু-হাজার টাকা টাই শর্মিলির হাতে ধরিয়ে দিল আর শর্মিলি কোন প্রশ্ন করার আগেই সেখান থেকে বেরিয়ে এল । একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল আজ ওর ।
~ সমাপ্ত ~
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.