কেন হামাস রকেট ছোঁড়ে?
ইসরাইল গাজায় স্থল অভিযান ‘অপারেশান প্রটেকটিভ এজ’ শুরু করেছে জুলাই আট তারিখে। এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে ইসরাইল গাজার ওপর বোমা হামলা চালিয়েছিল। আট দিন ধরে চলেছিল আকাশ থেকে বোমা মারা। সেই হত্যাযজ্ঞে ১৭১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল ইসরায়েল। এর গাল ভরা নাম ছিল, ‘অপারেশান পিলার অব ডিফেন্স’। এখন যে হত্যাযজ্ঞ চলছে তার আগে ২০০৮-২০০৯ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা উপত্যকায় ৩৩ দিন ধরে একটি সামরিক অভিযান চালায়। তার নাম তারা দিয়েছিল: ‘অপারেশান কাস্ট লিড’। এই বারের অপারেশানে তারা নারী ও শিশু সহ কমপক্ষে ১৩০০ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে। গাজার বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ নতুন কিছু নয়। কিন্তু বরাবর বর্বরতা ও হত্যার মাত্রা আগের যে কোন হত্যাযজ্ঞের বীভৎসতা ছড়িয়ে যাচ্ছে।
গিডিওন নিজে জন্মসূত্রে ইহুদি বাবা মায়ের সন্তান। বাবা ছিলেন সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার ইহুদি। এখন থাকেন তেল আবিবে। তাঁরও সন্তান আছে। আর ‘হারেৎজ’ ইসরায়েলের সবচেয়ে পুরানা ও বনেদি পত্রিকা। নামটাও হিব্রু ভাষায়: ‘হাদাশৎ হারেৎজ’। যার অর্থ ‘ইসরায়েলের ভূখণ্ড’। এটা অনুমান করা যায় ইসরায়েলের ইহুদিদের অধিকাংশই গিডিওনের লেখা কিম্বা হারেৎজ পত্রিকার নীতি পছন্দ করে না। গিডিওন বলেন, তাঁর নিজের ছেলেই নাকি তার লেখা পড়ে না। এবং তিনি যা লিখেন তার সঙ্গে তো তাদের একমত হবার প্রশ্নই ওঠে না। যেমন, ইসরায়েলের নীতি হচ্ছে আরবদের হত্যা করা। অধিকাংশ ইসরায়েলি এটা মানবে না।
আরবদের পরিকল্পিত ভাবে খুন করবার এই নীতি কি সাম্প্রতিক? মোটেও তা নয়। লেভি বলছেন ইসরাইলের এই মাফিয়া নীতি এখনকার নয় মোটেও। সেই ৩০ বছর আগের লেবানন যুদ্ধের সময় থেকেই ইসরায়েল এই নীতি অনুসরন করে আসছে। আর সেই নীতির অধীনেই এখন গাজায় ‘অপারেশান প্রটেক্টিভ এজ’ চলছে। কেন এই হত্যাযজ্ঞ? ঠণ্ডা মাথায় মহা হত্যা পরিকল্পনা ? এটা আসলে ইসরায়েলের যুদ্ধ নীতি। ইসরায়েল আসলেই মনে করে শত শত আরব খুন করে লাশের পাহাড় বানালে ফিলিস্তিনীরা ঠাণ্ডা হবে। এই দিকটা অস্বচ্ছ থাকলে এর ফিলিস্তিনী প্রতিরোধের মর্ম আমরা বুঝতে পারবো না।
গিডিওন লিখছেন, “হামাসের অস্ত্রের ভাণ্ডার ধ্বংস করা বেকার, কারন তারা আবার হাতিয়ার জোগাড় করবে। সেটা অবশ্য এতদিনে প্রমানিত হয়ে গিয়েছে। হামাসকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে আনাও হবে অবাস্তব (এবং অবৈধ) কাজ। ইসরাইল সেটা চায়ও না। কারন, হামাসের বিকল্প আরও বেকায়দার হতে পারে। তাহলে মিলিটারি অপারেশানের একটাই উদ্দেশ্য : আরবদের হত্যা করা, আর তার সঙ্গে মিলবে লোকজনের তালিয়া ও হর্ষধ্বনি” (Israel's real purpose in Gaza operation? To kill Arabs, HAARETZ, ১৩ জুলাই ২০১৪)
সামরিক পরিস্থিতির দিক থেকে বিচার করে দেখা যাক। সামরিক পরিস্থিতি ও সমর নীতি নিয়ে যারা গবেষণা করেন এবং ইন্টারনেটে যেসব খবর পাওয়া যায় তার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। যেমন, সমর নীতির দিক থেকে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এই হত্যাযজ্ঞকে মূল্যায়ন করব কিভাবে? ‘স্ত্রাটফর’ (Stratfor) একটি পরিচিত সমর ও গোয়েন্দা বিশ্লেষক সংস্থা। এই ওয়েবসাইটে জন্মসূত্রে ইহুদি জর্জ ফ্রিডমেন লিখছেন, “বিশুদ্ধ সমরবিদ্যার দিক থেকে দেখলে হামাস একটা পথ খুঁজছে যাতে গাজার বিরুদ্ধে হামলা চালানো থেকে ইসরাইলকে নিরস্ত করা যায়। ২০০৮ সালের শুরু ও ২০০৯ সালের শেষের দিকে ‘অপারেশান কাস্ট লীড’ গাজাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বড় ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। কিন্তু যতোটুকু ক্ষতি তারা করেছে পরিমানের দিন থেকে বিচার করলে তা ইসরাইলকে নিরস্ত করতে পারে নি” (দেখুন, Gaza Situation Report, by George Friedmen)।
হামাস এরপর থেকে তাদের রকেট বানানোর কৃৎকৌশল উন্নত করতে মনোযোগী হয়। স্বল্প পাল্লার রকেটের জায়গায় তারা এখন দূর পাল্লার রকেট বানাচ্ছে। ইসরায়েলি সৈন্যদের ওপর বিস্তর ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা অর্জন ছাড়া ইসরায়েলিদের আরব হত্যা নীতি থেকে নিরস্ত করা সম্ভব নয়। ইসরাইল এই নীতিটা কার্যকর করছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার কথা বলে। ইসরাইল ও তাদের মিত্ররা দাবি করে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে নিজেকে রক্ষা করার অধিকার ইসরাইলের আছে। কিন্তু বিপরীতে ইসরাইলের হাত থেকে মজলুমের নিজেকে রক্ষার অধিকার ইসরায়েলের মিত্ররা স্বীকার করে না। আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই অসম ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে ফিলিস্তিনীরা যারপরনাই নিরাপত্তাহীন। ইসরায়েলের আরব হত্যা নীতির মুখে তাদের সামনে দুটো পথ মাত্র খোলা। এক. ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞের মুখে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, অথবা প্রাণপণ যুদ্ধ করা।
হামাস দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিয়েছে। আর এই নীতিটাই ফিলিস্তিনীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তার কারন। যারা এই বাস্তবতা না জেনে এবং ইসরাইলের যুদ্ধ নীতি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান ছাড়া কেন হামাস রকেট ছোঁড়া বন্ধ করে না বলে হাঁসফাঁস করছেন, আশা করি তারা তাদের ভুল বুঝবেন। হামাসের প্রতিরোধ সমর্থন না করার অর্থ ইসরায়েলের আরব নির্মূল নীতি সমর্থন করা। এই অর্থে যে হাত পা না ছুঁড়ে ফিলিস্তিনীদের আত্ম বিলুপ্তির পথ বেছে নিতে বলা। এই নীতি গ্রহণ করলে ইসরায়েলিদের হাতে ক্রমাগত নিহত হতে হতে গাজার উদ্বাস্তুরা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যারা এভাবে ভাবছেন, আশা করি তারা তাদের ভুল বুঝবেন।
হামাস সম্প্রতিকালে যে রকেট বানাতে পারছে সেটা ইসরায়েলের ইহুদি বসতি অবধি পৌঁছাতে পারে। যেটা ত্রিভূজ নামে পরিচিত: জেরুজালেম, তেল আবিব ও হাইফা। ফ্রিডমেন বলছেন এই সক্ষমতা সত্ত্বেও হামাসের এই অস্ত্রগুলো রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র নয়। ফলে সুনির্দিষ্ট ভাবে তারা টার্গেটে আঘাত করতে পারে না। কিন্তু তারপরও ফ্রিডম্যান বলছেন, এই রকেট তৈরির পেছনে হামাসের সামরিক উদ্দেশ্য হচ্ছে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামাস আঘাত করতে সক্ষম এই খবরটুকু অন্তত ইসরায়েলিদের বুঝিয়ে দেওয়া। আশা এতে ইসরায়েলিরা কিছুটা নিরস্ত হবে। হামাস ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে বুঝিয়ে দিতে চায়, তারা যদি নিরীহ বেসামরিক নারী পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করে, তাহলে লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করতে অক্ষম হলেও কাসেম ব্রিগেডের রকেট বেসামরিক জায়গাগুলোতে ঠিকই আঘাত করতে সক্ষম। আর যদি হামাস তা করতে বাধ্য হয় তবে তার দায় দায়িত্ব ইসরায়েলের।
রকেট গাজায় স্থল অভিযান চালানোর ইসরায়েলি সিদ্ধান্তের প্রধান কারন। রকেটগুলো খুঁজে বের করা ইসরায়েলি সেনা অভিযানের লক্ষ্য হবে, এটা নিশ্চিত। আকাশ থেকে বোমা মেরে তাদের ধ্বংস করাটাই ছিল সবচেয়ে সুবিধার আর আরামের। কিছু হয়তো তথ্য থাকলে সম্ভব, কিন্তু খুঁজে বের করে ধ্বংস করা ছাড়া ইসরাইলের কাছে আর কোন সামরিক কৌশল নাই। অতএব গাজায় একটি বড়সড় সামরিক অভিযানের সম্ভাবনা পুরামাত্রায় রয়েছে। কিন্তু সেটা ইসরাইলের জন্য খুব সুখের হবে না।
হামাস অপারেশান কাস্ট লিডের সময়ের চেয়ে এবার অনেক বেশী প্রস্তুত বলে বাইরে থেকে মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের ‘মারকাভা’ ট্যাংক উড়িয়ে দেবার জন্য হামাসের হাতে এন্টি ট্যাংক মিসাইল রয়েছে । সামনা সামনি স্থল যুদ্ধে হামাসের সঙ্গে পেরে ওঠা দুঃসাধ্য। গাজার ফিলিস্তিনীদের কিছুই হারাবার নাই। তারা মরবে, কিন্তু মেরেই মরবে। আর এটাই ইসরায়েলের জন্য বিপজ্জনক বার্তা। তাছাড়া স্থল অভিযান খুবই ব্যয়বহুল। এর পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করাও সহজ নয়।
আরবদের হত্যাই ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি -- এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের স্থল অভিযানের পরিণতি শেষ মেষ কি দাঁড়াবে আমরা এতো দূর থেকে নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারি না। তবে এটা বলা যায় বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি নীতির বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে উঠেছে, তাতে হামাসেরই জয় হয়েছে। সেটা রাজনৈতিক দিক। কিন্তু যুদ্ধ ক্ষেত্রের ফলাফল বাইরের মতামত দিয়ে স্থির হবে না। আমাদের অপেক্ষা করে দেখতে হবে স্থল অভিযানের ফল কী দাঁড়ায়।
যারা রাজনীতিকে সমর নীতির দিক থেকে এবং সমর নীতিকে রাজনীতির পাল্লা দিয়ে মাপজোক করতে পারেন হামাসের রাজনীতি ও যুদ্ধনীতি থেকে তারা অনেক কিছুই শিখবেন। যদি নিরপেক্ষ জায়গা থেকে তারা বাস্তবতা বিচার করেন, তাহলে হামাসকে প্রশংসা না করে তারা পারবেন না।
চরম ও পরম শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে দাঁড়িয়ে কিভাবে লড়তে হয়, হামাস তার দুর্দান্ত নজির স্থাপন করেছে। এটা স্বীকার না করে উপায় নাই। আর এটাই মানবেতিহাসে সবসময়ই ইতিহাসের চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে। ছাই থেকে পাখা মেলে উড়াল দেবার মতোন।
মানুষের ডানা নাই, কিন্তু তার স্বভাবের মধ্যে ডানা আছে। তার পালকগুলো নড়ে ওঠে প্রায়ই। মজলুমের লড়াই যেমন।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.