এনু-রুপনের ‘টাকার গোডাউনে’ অভিযান: সিন্দুকে ২৭ কোটি টাকা!
ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতার এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূঁইয়ার আরেক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২৭ কোটি (২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা) টাকা পেয়েছে র্যাব।
পাঁচটি সিন্দুকে থরে থরে সাজানো এই টাকা ছাড়াও সেখান থেকে ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআরের কাগজপত্র, মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ও প্রায় এক কেজি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করা হয়। এনু ও রুপন- এ দুই ভাই গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে র্যাব-৩ এর একটি দল সোমবার রাত সাড়ে ১২টায় পুরান ঢাকার ১১৯/১ লালমোহন সাহা স্ট্রিটে মমতাজ ভিলায় অভিযান শুরু করে।
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টা চলে শ্বাসরুদ্ধকর এ অভিযান। ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে এ অভিযান শুরু হয়। বাড়িটির নিচতলার প্রায় পুরোটাই এই ‘টাকার গোডাউন’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার মধ্যরাতে বাড়িটি ঘেরাও করে র্যাব। পরে নিচতলার একটি ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে দুটি রুমে থাকা এসব সিন্দুক ও টাকার ব্যাগের সন্ধান পাওয়া যায়।
সরেজমিন দেখা গেল, রীতিমতো একটি ‘টাকার গোডাউন’ অথচ সেখানে নেই কোনো মানুষ। পুরো ঘটনাটিই যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। ব্যাংকের ভল্টেও এত নগদ টাকা থাকতে পারে কিনা- এমন প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। অর্থের পরিমাণ শুনে ‘চক্কু চরকগাছ’ হতে পারে যে কারও। ঘণ্টা দেড়েক ধরে দুই মেশিনে চলে টাকা গোনার কার্যক্রম।
৬ তলা ভবনে ঢোকার মুখেই একটি কক্ষের দুটি ভারী সিন্দুক। ব্যাংক বা সরকারি মহাফেজখানায় দেখা যায় এগুলো। এমন সিন্দুক ফ্ল্যাটটির অন্য কক্ষেও। সব সিন্দুকই এক হাজার টাকার নতুন নোটে ভরা।
সব টাকা একত্র করতে দরকার হয় ১৫টি বস্তার। সেখানে আরও পাওয়া গেছে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কিছু ক্যাসিনো সরঞ্জামও। গণনা শেষে দুপুর ২টার দিকে সুরক্ষিত ট্রাংকে নগদ টাকা, এফডিআর ও স্বর্ণালঙ্কার তোলা হয় র্যাবের ট্রাকে।
এর আগে অভিযান শেষে মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান শুরু হয়েছিল তার অংশ হিসেবে সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে এই বাড়িতে আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করি। নিচতলার ওই বাসায় কেউ থাকত না। বেশ সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা ছিল সবকিছু।
এনু-রুপনের দুই ডজন বাড়ির বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা এ বাসার সন্ধান পাই। অভিযান শেষে জব্দ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও বিদেশি মুদ্রার ফিরিস্তি তুলে ধরে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, বাসাটি থেকে নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা, ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআর, প্রায় এক কেজি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার, ৯ হাজার ৩০০ ইউএস ডলার, ১৭৪ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, ৫ হাজার ৩৫০ ইন্ডিয়ান রুপি, এক হাজার ১৯৫ চাইনিজ ইয়েন, ১১ হাজার ৫৬০ থাইবাথ ও ১০০ দিরহাম ইউএই জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া কিছু ক্যাসিনো সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এখন এ ব্যাপারে আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণ করব। এসব দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার থানায় হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হবে। জব্দ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার কিসের বা কোথা থেকে এলো জানতে চাইলে র্যাব-৩ এর সিও বলেন, আমরা এটা তদন্ত করে বের করব। কোথা থেকে এসেছে, কার কাছে ছিল, গন্তব্য কোথায় ছিল তা ইনভেস্টিগেশন করে বের করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা যে বাসায় অপারেশন পরিচালনা করেছি, সেই ছয়তলা ভবনটি এনু-রুপনের বাড়ি। এর আগে তাদের আরেক বাসায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। ওই অভিযানের পর কি এই মুদ্রা-স্বর্ণালঙ্কার এ বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে রাকিবুল হাসান বলেন, সম্পূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা এ বাসায় অভিযান পরিচালনা করেছি। কতগুলো বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা সময়সাপেক্ষ। পরে তা জানা যাবে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম বলেন, পুরান ঢাকার ওই বাসার ঠিকানা ১১৯/১ লালমোহন সাহা স্ট্রিটের সরু গলির ওই বাসায় পাঁচটি সিন্দুকভর্তি টাকা রাখা হয়েছিল। বাসাটি খুব ছোট আকারে। এখানে মাত্র একটি চৌকি ছিল। এটি ছয়তলা ভবনের নিচতলার একটি বাসা। ধারণা করা হচ্ছে, এ বাসায় টাকা রেখে কেউ এর পাহারায় থাকতেন। তবে এখান থেকে কাউকে আটক করা যায়নি।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পরিচালক এনামুল হক এনু ছিলেন গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তার ভাই রুপন ভূঁইয়া ছিলেন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক।
গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার কয়েকটি ক্লাবের সঙ্গে ওয়ান্ডারার্সে অভিযান চালিয়ে জুয়ার সরঞ্জাম, কয়েক লাখ টাকা ও মদ উদ্ধার করে র্যাব। এরপর ২৪ সেপ্টেম্বর গেণ্ডারিয়ায় প্রথমে এনু ও রুপনের বাড়িতে এবং পরে তাদের এক কর্মচারী ও তাদের এক বন্ধুর বাসায় অভিযান চালিয়ে পাঁচটি সিন্দুকভর্তি প্রায় ৫ কোটি টাকা, আট কেজি স্বর্ণ এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। র্যাবের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, সিন্দুকে পাওয়া ওই টাকার উৎস ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো থেকে।
টাকা রাখতে জায়গা বেশি লাগে বলে কিছু অংশ দিয়ে স্বর্ণ কিনে রাখতেন এনামুল। ওই ঘটনার পর মোট সাতটি মামলা করা হয়, যার মধ্যে অবৈধ ক্যাসিনো ও জুয়া পরিচালনা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে চারটি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।
ক্যাসিনোর টাকায় অঢেল সম্পদ : ১৩ জানুয়ারি নাটকীয়ভাবে কেরানীগঞ্জ থেকে এনু ও রুপনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এরপর দুই দফায় সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা সিআইডিকে অঢেল সম্পদের তথ্য দেন। এখন পর্যন্ত এনু-রুপন সিআইডিকে ২৪ বাড়ির তথ্য দিয়েছেন। এসব বাড়ির ফ্ল্যাটসহ ঢাকায় ১২১টি ফ্ল্যাট, ১২ প্লটে ৭২ কাঠা জমি এবং পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কথা জানিয়েছেন তারা।
এছাড়া দুদকের ৫ দিনের রিমান্ডেও তারা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। সিআইডিকে এনু-রুপন তাদের সম্পদের যে ফিরিস্তি দিয়েছেন সে অনুযায়ী রাজধানীর সূত্রাপুরে ৩১ নম্বর বানিয়ানগরে ছয়টি ফ্ল্যাট, ওয়ারীর ১০৫ নম্বর লালমোহন সাহা স্ট্রিটে পাঁচটি ফ্ল্যাট, ১০৬ লালমোহন সাহা স্ট্রিটের ১০ তলা ভবনে ১০টি ফ্ল্যাট, একই স্ট্রিটের ১০৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে এক কাঠার একটি প্লট, ১১৬ নম্বর হোল্ডিংয়ে ছয়টি ফ্ল্যাট, ১১২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ছয়টি ফ্ল্যাট এবং ১২০ নম্বর হোল্ডিংয়ে এক কাঠার প্লট রয়েছে। প্রত্যেকটি এক ইউনিটের বাড়ি।
ওয়ারীর ৭০ নম্বর দক্ষিণ মৈসুন্দিতে সাত তলা ভবনের ১৪টি ফ্ল্যাটের মালিক তারা। গেণ্ডারিয়ার ৬৫/২ শাহ সাহেব লেনে ১০ তলা ভবনের ১৭টি ফ্ল্যাটের মালিক রুপন। একই লেনের (৭০ বা ৭১ নম্বর হোল্ডিং) ছয় তলা বাড়িতে রুপনের নামে আছে চারটি ফ্ল্যাট। ওই লেনের ৮ নম্বর হোল্ডিংয়ে একটি চার তলা বাড়িতে ১৩টি ফ্ল্যাটের মালিক এনু।
গেণ্ডারিয়ার ১ নম্বর নারিন্দা লেনের চার তলা বাড়িতে তাদের পাঁচটি ফ্ল্যাট, ১৫ নম্বর নারিন্দা লেনের ছয় তলা বাড়িতে ১১টি ফ্ল্যাট, ছয় নম্বর গুরুদাস লেনের ছয় তলা বড়িতে ১২টি ফ্ল্যাট, গেণ্ডারিয়ার ১৩৫ নম্বর ডিস্টিলারি রোডে একটি টিনশেড বাড়ি আছে তাদের। ওয়ারী থানার পেছনে ৪৪/বি ব্রজহরি শাহ স্ট্রিটে ৪ কাঠার একটি প্লট, ৮৮ মুরগিটোলায় নয় কাঠার প্লট, কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া এলাকায় ১৫ কাঠা জমির ওপর এক তলা তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট আছে দুই ভাইয়ের।
এছাড়া মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ১০ কাঠার একটি প্লট আছে। তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে পুরান ঢাকার ২৯ নম্বর বানিয়ানগরে রুপন স্টিল হাউস, বংশালের ১৪ নম্বর নবাব ইউসুফ রোডে এনু-রুপন স্টিল হাউস, একই রোডে একটি দোকান, ধোলাইখালে বাঁধন এন্টারপ্রাইজ এবং ২৯ নম্বর বানিয়ানগরে সুমন শিট কাটিং নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
আর ১০৩ লালমোহন স্ট্রিটের পাশে আধা কাঠা খালি জমি, ১১৯ লালমোহন স্ট্রিটে আধা কাঠা জমিসহ ছয় তলায় একটি ফ্ল্যাট, শরীয়তপুরের নাড়িয়ায় ১২ শতাংশ জমি, পালংয়ের দোশমা গ্রামে ৩৪ শতাংশ জমি, রাজধানীর নারিন্দার ১৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে তিনটি ফ্ল্যাট, ৬৫ নম্বর শাহ সাহেব লেনে একটি টিনশেড বাড়ি আছে। এ ছাড়া ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান জাহিদ ডায়েমের মাধ্যমে তাদের দুটি বাড়ি নির্মাণাধীন।
হ্যারির হাত ধরে আলাদিনের চেরাগ : অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনু ও রুপনরা সাত ভাই ও এক বোন। তার বাবা সিরাজুল ইসলামও পেশাদার জুয়াড়ি ছিলেন। তিনি গত সপ্তাহে মারা গেছেন। তাকে দেখতে প্যারোলে জামিন নিয়ে এসেছিলেন দুই ভাই। বাবা সিরাজ একসময় আজাদ ক্লাবে নিয়মিত জুয়া খেলতেন।
হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি এনু-রুপন। একসময় পুরান ঢাকায় লেদ মেশিনের দোকানে চাকরি করলেও পরে খুলে বসেন লোহার শিটের ব্যবসা। শিটের ব্যবসায় খুব একটা মুনাফা হতো না। ফলে বাবার সঙ্গে প্রায়ই আজাদ ক্লাবে যেতেন দুই ভাই। পরে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তারা। ওই ক্লাব ভাড়া নিয়ে ‘ওয়ান-টেন’ খেলা চালান এনু-রুপন। এতেও তেমন লাভ হতো না।
এরপর নামেন ক্যাসিনো ব্যবসায়। প্রায় তিন বছর আগে ক্যাসিনোর ম্যাজিকম্যান নেপালি নাগরিক হ্যারির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তার মাধ্যমে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনোর আসর বসান। ক্যাসিনোর সরঞ্জাম হ্যারির মাধ্যমে ক্লাবে ঢোকে। লাভের নির্দিষ্ট অঙ্ক হ্যারি পেতেন। বাকিটা পেতেন তারা।
প্রতি রাত ১০টার পর দুই ভাই বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে যেতেন। ওই সময় হ্যারির কাছ থেকে লাভ-লোকসানের হিসাব নিতেন। ক্যাসিনো কারবার শুরুর পর দুই ভাইয়ের হাতে যেন চলে আসে ‘আলাদিনের চেরাগ’।
প্রতিদিন বড় অঙ্কের লাভের টাকা পেতেন দুই ভাই। বস্তা ভরে টাকা নিয়ে যেতেন বাসায়। মূলত বাবার হাত ধরে জুয়ায় এলেও ক্যাসিনোর মাধ্যমে বদলে যায় তাদের জীবনের গল্প। পড়াশোনা বেশি না জানা থাকলেও চলন-বলনে অনেক স্মার্ট ছিলেন দুজনই। তাদের সম্পদের অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা।
আরও জানা গেছে, বিপুল বিত্তবৈভব গড়লেও ট্যাক্স ফাইলে এখনও সম্পদ বলতে সেই পুরনো এনু-রুপন স্টিল মিলস নামের লোহালক্কড়ের ব্যবসা থেকে অর্জিত আয়কেই দেখিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। যা কিছু সম্পদ তার মালিক এনু, রুপন, রশিদুল, দুলু, আমিনুল, শিপলু, তাদের মা মমতাজ বেগম ও বোন চম্পা এবং মৃত এক ভাইয়ের সন্তানেরা।
এসব সম্পদের মধ্যে অধিকাংশই কিনেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। তাদের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে সোনালি রং বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। বাড়ির গেট এবং অধিকাংশ কমোডও সোনালি রঙের। মূলত সোনালি রং দুই ভাইয়ের প্রিয় রং। তবে সোমবার রাতে লালমোহন শাহ স্ট্রিটের যে বাড়িতে অভিযান হয়েছে সেটি ছিল তাদের পুরনো বাড়ি।
সরু-গলির কারণে ওই বাড়িটির রং-নকশা পরিবর্তন করতে পারেননি তারা। জুয়ার টাকায় এনামুল ও রূপন কেবল বাড়ি ও ফ্ল্যাটই কেনেননি, ক্ষমতাসীন দলের পদও কেনেন বলে জানা যায়। ২০১৮ সালে এনামুল পান গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ। আর রূপন পান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ।
তাদের পরিবারের পাঁচ সদস্য, ঘনিষ্ঠজনসহ মোট ১৭ জন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগে পদ পান। তারা সরকারি দলের এসব পদ-পদবি জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার নির্বিঘ্নে চালানোর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান। তাছাড়া সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কাউন্সিলর হওয়ারও স্বপ্ন দেখছিলেন দুই ভাই।
যেভাবে গ্রেফতার হয়েছিলেন : ক্যাসিনোবিরোধী র্যাবের অভিযানের পরপরই গা-ঢাকা দেন এনু ও রুপন। প্রথম তিন দিন ঢাকায় থাকেন। এর পরদিন একই সঙ্গে কক্সবাজারে চলে যান দুই ভাই। সেখানে চারটি হোটেলে ঘুরেফিরে ১৫ দিন অবস্থান করে আবার ঢাকায় চলে আসেন।
তাদের বিশ্বস্ত কর্মচারী শেখ সেলিম মোস্তফার মাধ্যমে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা এলাকার সাবান ফ্যাক্টরি রোডে ১০ তলা বাড়ির ষষ্ঠতলার একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে গা-ঢাকা দিয়ে থাকেন এ দুই ভাই। গত ৯ অক্টোবর ওই ফ্ল্যাটে উঠে আত্মগোপন করেছিলেন এনু-রুপন। এর পর থেকে তিন মাস ওই ফ্ল্যাটে অবস্থান করলেও তারা বাসা থেকে একটি বারের জন্যও বের হননি।
তাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তা নিয়ে আসতেন মোস্তফা। এনুর বাবা সিরাজুল হক ভূঁইয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু গ্রেফতারের ভয়ে বাবাকেও দেখতে আসেননি দুই ভাই। এমনকি পরিবারের কোনো সদস্যকেও কেরানীগঞ্জের ওই ফ্ল্যাটে তারা নেননি। ১৩ জানুয়ারি ভোরে সিআইডি যখন এনু-রুপনের খোঁজে কেরানীগঞ্জের ওই ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়লেও ভেতর থেকে প্রথমে কোনো সাড়া মিলছিল না। প্রায় ১৫ মিনিট পর মোস্তফার স্ত্রী দরজা খুলে দেন।
ওই বাসায় মোস্তফা, তার স্ত্রী, এক শিশু ও আরেক বৃদ্ধ নারীকে দেখতে পায় সিআইডি। এনু-রুপনের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, বাসায় আর কেউ থাকেন না। এরপর সিআইডির সদস্যরা আরেকটি কক্ষে গিয়ে দেখেন, সেখানে লেপ বিছানো। টেবিলের ওপর দামি সিগারেট ও কয়েকটি সিগারেটের খণ্ডাংশ পড়ে আছে দেখেন।
এতে তারা নিশ্চিত হন ওই ফ্ল্যাটের কোথাও না কোথাও এনু-রুপন আছেন। তবে ফ্ল্যাটের বিভিন্ন কক্ষে খোঁজাখুঁজি করেও তারা দুই ভাইয়ের সন্ধান পাচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে বাসার ভেতরে শীতের পোশাক রাখার ছোট্ট কার্নিশের দরজা খুলে তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় হঠাৎ একজনের পা বেরিয়ে আসে। তাকে টেনে বের করার সময় ভেতর থেকে আরেকজন চিৎকার করে ওঠেন। এরপরই সন্ধান মেলে দুই ভাইয়ের।
পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তারা পোশাক পরিবর্তন করার জন্য কিছু সময় চান। ওই সময়ের মধ্যে বাসায় তল্লাশি করে একটি ড্রয়ারে ৪০ লাখ টাকা পায় সিআইডি। তখন তারা সিআইডিকে জানিয়েছিলেন, ভুয়া নাম-ঠিকানায় পাসপোর্ট তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এ জন্য এক দালালের সঙ্গে তাদের ৩০ হাজার টাকার চুক্তি হয়।
তাদের কাছে সিআইডি ১২টি সিমকার্ড পায়। তবে ক্যাসিনোকাণ্ডের পর দুই ভাই স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন না। মোস্তফার ফোনের মাধ্যমে প্রয়োজন হলে অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতেন তারা। তাদের টার্গেট ছিল ভুয়া পাসপোর্টে প্রথমে নেপাল এরপর সেখান থেকে ভারত-মালয়েশিয়া হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানোর।
গ্রেফতারের পর সিআইডির কাছে এ দুই ভাই তাদের উত্থানের নানা চমকপ্রদ তথ্য দেন। তারা জানিয়েছেন, পুরান ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহীদ একসময় যেসব খাত থেকে চাঁদা তুলত, সেসব খাত পরবর্তীতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন তারা। এখন দুই ভাই কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.