পুরুষের অলঙ্কার পরিধানের বিধান!
১ম মতঃ
নারীর অলঙ্কারের ব্যাপারে ইসলাম অনেকটা নমনীয়। কিন্তু পুরুষের অলঙ্কার ব্যবহারের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক নিয়মনীতি, যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে পুরুষের জন্য স্বর্ণ ব্যবহারের অনুমতি থাকলেও পরে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স) স্বর্ণের আংটি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন (বোখারি ও মুসলিম)। হজরত হুবাইরা ইবনে বারিম (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী (রা) বলেছেন, রসূলুল্লাহ (স) আমাকে স্বর্ণের আংটি ও রেশমি কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন এবং লাল গদিতে বসতে, আর যব এবং গমের শরবত পান করতে নিষেধ করেছেন। (নাসাঈ)।
হাদিসে রুপার আংটি পরার অনুমতি দিলেও তা ততটা গুরুত্ব বহন করে না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা (রা) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, রসূলুল্লাহ (স) এর কাছে এক লোক আগমন করল, যার হাতে ছিল একটি লোহার আংটি। তখন রসূল (স) বললেন, তোমার হাতে দোজখিদের পোশাক দেখছি কেন? তখন সে ব্যক্তি তা খুলে ফেলে দিল। দ্বিতীয়বার যখন ওই লোকটি আবার এলো, তখন তার হাতে ছিল পিতলের আংটি। তখন রসূল (স) বললেন, আমি তোমার কাছ থেকে মূর্তির গন্ধ পাচ্ছি, তখন সে তা ফেলে দিল এবং বলল, ইয়া রসূলুল্লাহ তাহলে আংটি কোন্ বস্তু দ্বারা তৈরি করব? তখন রসূল (স) বললেন, রুপার আংটি তৈরি করো, আর তা যেন সাড়ে চার মা’শা হতে কম হয় (নাসাঈ)। হজরত ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত, রসূল (স) একটি রুপার আংটি তৈরি করেছিলেন, এটা তার হাতে ছিল, তারপর আবু বকর (রা) খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তার হাতে ছিল। তারপর ওমর (রা) এর হাতে, তারপর ওসমান (রা) এর হাতে ছিল। তারপর তার হাত থেকে মদিনার ‘আরিস’ নামক কূপে পড়ে যায়, তা আর পাওয়া যায়নি। আংটির ওপর ‘মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ’ খোদিত ছিল (বোখারি)।
উল্লেখ্য, অত্র হাদিস অনুযায়ী রসূল (স) এর আংটিতে খোদাই করা থাকলেও তা অন্যদের জন্য খোদাই করা নিষেধ ছিল। যা অন্য হাদিসে বিদ্যমান। আংটি কোন্ হাতে এবং কোন্ আঙুলে পরতে হবে তা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রা) বর্ণিত যে, রসূল (স) তার ডান হাতে আংটি পরতেন। (নাসাঈ)। বাম হাতে পরারও বর্ণনা রয়েছে। রসূল (স) যখন পায়খানায় প্রবেশ করতেন, তখন তাঁর আংটি খুলে রাখতেন (নাসাঈ)। তর্জনী, মধ্যমা, বৃদ্ধা ও কনিষ্ঠ আঙুলে আংটি পরা নিষেধ। হজরত আলী (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (স) আমাকে এ আঙুলে অর্থাত্ বৃদ্ধা ও কনিষ্ঠতে আংটি পরতে নিষেধ করেছেন (ইবনে মাজাহ)।
অনুরূপভাবে রুপা দ্বারা নির্মিত অলঙ্কারও পুরুষের জন্য ব্যবহার করা জায়েজ নেই। কেননা রুপা মূলত স্বর্ণের মতোই, তবে রুপার আংটি কোমর বন্ধনী এবং তরবারির অঙ্গসজ্জার জন্য রুপার ব্যবহার হলে তা জায়েজ। কেননা, এগুলো নমুনার মতো জিনিস, আর রুপায় যেহেতু স্বর্ণের কাজ হয়, তাই স্বর্ণ ব্যবহার করা আমাদের আবশ্যক নয়, রুপার ব্যবহার মোবাহ হওয়ার ক্ষেত্রে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। জামে সগীর গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর আংটি পরিধান করা জায়েজ নেই। তাতে প্রতীয়মাণ হয় যে, পাথর, লোহা এবং পিতল দ্বারা আংটি তৈরি করা নিষিদ্ধ। আংটির ক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে যে, আংটি ব্যবহার হারাম, প্রয়োজনের তাগিদে সিলমোহর ও নমুনার ক্ষেত্রে মোবাহ করা হয়েছে। অন্যদিকে বাদশাহ তথা রাষ্ট্রপ্রধান ও বিচারকের যেহেতু সিলমোহরের প্রয়োজন হয় তাই তারা আংটি ব্যবহার করতে পারবেন। তাদের ব্যতীত অন্যান্য ব্যক্তিদের জন্য আংটির ব্যবহার বর্জন করা উত্তম। ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন, আংটির নকশার ছিদ্রের স্বর্ণের তৈরি পেরেক ব্যবহারে কোনো দোষ নেই। কারণ, এটি আংটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বস্তু (মূল বস্তু নয়)। যেমন কাপড়ে খচিত নকশা। অতএব এ কারণে তাকে স্বর্ণ পরিধানকারী বলে গণ্য করা হবে না।
সফরকালীন অবস্থায় নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ সঙ্গে ব্যবহার করা যাবে। আমাদের সমাজে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, পুরুষরা বিভিন্ন ধরনের ধাতু দ্বারা বিভিন্ন রকম অলঙ্কার ব্যবহার করে থাকে, যা হাদিসের পরিপন্থি। পুরুষের অলঙ্কার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যত হাদিস উল্লেখ আছে তা প্রায় সবগুলোই প্রয়োজনের আয়োজন মাত্র।
২য় মতঃ
পুরুষদের আংটি ব্যবহার : পুরুষের জন্য রুপার আংটি ব্যবহার করা জায়েজ; কারো কারো মতে তা সুন্নাত। কিন্তু রূপা ব্যতিত অন্য কোন ধাতু বা পাথর ব্যবহার করা নিষেধ; বিশেষ করে সোনার আংটি সম্পূর্ণরূপেই নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে পাথর ব্যবহার করাও অনুমোদিত নয়।
বিশেষ উদ্দেশ্যে আংটি বা পাথর ব্যবহার : শনির দশা, রাহুর গ্রাস ও কালের দৃষ্টি থেকে রক্ষা; ফাড়া কাটানো, দূর্ভাগ্য দূর করা, সৌভাগ্য আনয়ন করা; রোগমুক্তি বা আরোগ্য লাভ এবং সুস্বাস্থ্য অর্জন ও নিরোগ থাকা- এসব উদ্দেশ্যে আংটি ও পাথর ব্যবহার করা একাধারে অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক, অপরিণামদর্শী, অজ্ঞতাপ্রসূত, হারাম ও শিরিক। কারণ এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়; বিশ্ব সাস্থ সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয়; কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত শরীয়াসম্মত পন্থাও নয়। বিশেষত রাশির সাথে মিল করে যে পাথর দেয়া হয়, ইসলামী বিধান মতো ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সে রাশিও বাস্তবসম্মত নয়; এবং তা বিশ্বাস করাও অজ্ঞতা ও শিরিক।
মূর্খতার প্রতীক বিভিন্ন প্রকারের আংটি : পাথরের আংটি, তামার আংটি, পিতলের অংটি, অষ্টধাতুর আংটি, পারদের অংটি, ঘোড়ার নালের আংটি। ব্রোঞ্জের আংটি, পিতলের আংটি, দস্তার আংটি, কাসার আংটি, স্টীলের আংটি, লোহার আংটি ইত্যাদি।
মহানবী (সা.) -এর আংটি ব্যবহার : আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সাধারণত কোনো প্রকার অলঙ্কার ব্যবহার করতেন না। রাষ্ট্রীয় দাফতরিক কাজের প্রয়োজনে সীল মোহর হিসেবে রূপার আংটি ব্যবহার করেছেন। সে আংটির হলকা বা রিং এবং নগিনা বা পাত উভয় ছিলো রূপার। তাতে লেখা ছিলো- মুহাম্মাদ রাসূল আল্লাহ। তিনি এ আংটি ডান হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলে পরতেন। তিনি কখনো আংটিতে পাথর ব্যবহার করেনি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। তাই কোনো ফকীহের মতে পুরুষ শুধু প্রয়োজনেই আংটি ব্যবহার করতে পারবে, কারো কারো মতে পুরুষের জন্য সাধারণভাবে অংটি পরা অনুমোদিত, আবার কারো মতে আংটি ব্যবহার করা সুন্নাত; তবে সর্বাবস্থায় সেটি শূধুমাত্র রূপারই হতে হবে।
মহিলাদের জন্য আংটির বৈধ উপকরণ : সোনা, রূপা, কাঠ, পোড়া মাটি, কাঁচ, চাঁচ, রাবার, প্লাস্টিক, মুক্তা, পাথর (হিরা, চুনী, পান্না, রুবী, ইয়াকূত, যমরূদ, মার্বেল, কষ্টি পাথর) ও শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি। মহিলাদের জন্য এসব ব্যবহারে বাধা নেই; পুরুষদের জন্য রূপার আংটি ছাড়া অন্য কিছু ব্যহার করা জায়েজ নেই।
আংটি ও অলঙ্কার ব্যবহারে ডান-বাম : হাদীস শরীফে আছে, রাসূলে কারীম (সা.) সকল কর্মে ডান দিককে প্রধান্য দিতেন। (আবূ দাঊদ শরীফ)। তাই আংটি বা যে কোনো অলঙ্কার ডান অঙ্গে পরা এবং ডান দিক থেকে পরিধান করতে শুরু করা সুন্নাত। এই নিয়ম পুরুষ মহিলা সবার জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য।
রত্ন পাথরের জাকাত : যেহেতু অংটি কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস নয়, তাই আংটি যদি অত্যধিক মূল্যবান হয় এবং অনুরূপ কোনো মূল্যবান রত্ন পাথর বা পাথরের শোপিস ইত্যাদির মূল্য হিসাব করে তার জাকাত প্রদান করতে হবে। এসব ব্যবহারে থাকুক বা এমনিতেই থাকুক উভয়াবস্থায় জাকাতের আওতাধীন হবে।
মুফতী শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট
৩য় মতঃ
পুরুষদের আংটি পরিধানের ব্যাপারে আমাদের শরিয়ত কি বলে? আংটি স্বর্ণ বা রুপার পরিমান কি হলে পরিধান করা যাবে?
জবাব:
এক- পুরুষদের জন্য আংটির মধ্যে কেবলমাত্র রূপার আংটি ব্যবহার করা জায়েয আছে। তবে তা এই শর্তে যে, রূপার পরিমাণে এক মিসকালের চেয়ে কম অর্থাৎ সাড়ে চার মাশার চেয়ে কম হতে হবে। গ্রামের হিসাবে এক মিসকালের পরিমাণ হল ৪.৩৭৪ গ্রাম।(ফাতাওয়া কাযী খান ৩/৪১৩)
তাকদীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনা বিশেষ উদ্দেশ্যে আংটি ব্যবহার যেমন–শনির দশা, রাহুর গ্রাস ও কালের দৃষ্টি থেকে রক্ষা; ফাড়া কাটানো, দূর্ভাগ্য দূর করা, সৌভাগ্য আনয়ন করা; এসব উদ্দেশ্যে আংটি ব্যবহার করা হারাম ও শিরিক। (আহসানুল ফাতওয়া খণ্ড : ৮, পৃ. ৬৯-৭০)
যেসব ধাতু কাফিরদের সঙ্গে কিংবা তাদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ যেমন শিশা, পিতল, কাঁসা ও লোহার আংটি ব্যবহার করা মুসলমানদের জন্য মাকরূহ। পিতল, কাঁসা ইত্যাদি ধাতব কাফিরদের মূর্তি নির্মাণ ও আসবাবপত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয়। তাদের অনেকে লোহাকে বিশেষ পূজা-অর্চনায় ব্যবহার করে- (ইসলাম বনাম বিজাতির অনুকরণ, হাকিমুল উম্মত ক্বারী তৈয়্যব সাহেব (রহ.) পৃ. ১৭১-১৭)। তাছাড়া দোযখীদেরও শাস্তিস্বরূপ লোহার বেড়ী পরানো হবে।
হাদিস শরিফে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّ رَجُلًا، جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ خَاتَمٌ مِنْ شَبَهٍ، فَقَالَ لَهُ: مَا لِي أَجِدُ مِنْكَ رِيحَ الْأَصْنَامِ؟ فَطَرَحَهُ، ثُمَّ جَاءَ وَعَلَيْهِ خَاتَمٌ مِنْ حَدِيدٍ، فَقَالَ: مَا لِي أَرَى عَلَيْكَ حِلْيَةَ أَهْلِ النَّارِ؟ فَطَرَحَهُ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مِنْ أَيِّ شَيْءٍ أَتَّخِذُهُ؟ قَالَ: اتَّخِذْهُ مِنْ وَرِقٍ، وَلَا تُتِمَّهُ مِثْقَالًا
একদা জনৈক ব্যক্তি পিতলের আংটি পরে নবী ﷺ–এর নিকট আসলে তিনি তাকে বলেন, ব্যাপার কি, আমি তোমার থেকে মূর্তির গন্ধ পাচ্ছি কেন? একথা শুনে সে ব্যক্তি তা খুলে ফেলে দেয়। এরপর সে ব্যক্তি একটি লোহার আংটি পরে আসলে, তিনি তাকে বলেন, আমি তোমাকে জাহান্নামীদের অলংকার পরা অবস্থায় দেখছি! তখন সে ব্যক্তি তা খুলে ফেলে দেয় এবং বলে, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি কী ধরনের আংটি ব্যবহার করবো? তিনি ﷺ বলেন, এক মিসকাল (৪.৩৭৪ গ্রাম) ওযনের কম রূপা দিয়ে আংটি তৈরী করে তা ব্যবহার কর। (আবু দাউদ ৪২২৩ তিরমিযি ১৭৮৫ নাসায়ি ৫১৯৫)
দুই- স্বর্ণের আংটি বা সোনার অন্য যে কোন অলংকার ব্যবহার পুরুষের জন্য একেবারে হারাম। আবু মুসা আশ‘আরী রাযি. রাসূলুল্লাহ্ ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন,
أُحِلَّ الذَّهَبُ وَالْحَرِيرُ لِإِنَاثِ أُمَّتِي، وَحُرِّمَ عَلَى ذُكُورِهَا
আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মতের নারীদের জন্য রেশম ও স্বর্ণ হালাল করেছেন এবং পুরুষদের জন্য হারাম করেছেন। (নাসায়ি ৫২৬৫)
والله اعلم بالصواب
-উত্তর দিয়েছেন
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.