তুরস্কের ছাত্র বিক্ষোভ কি এরদোগান সরকার পতনের দিকে নিয়ে যাবে?
গত কয়েকদিন ধরে তুরস্কের অন্যতম বিদ্যাপীঠ বোয়াযইচি বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভে উত্তাল। নবনিযুক্ত রেক্টর প্রফেসর ড. মেলিহ বুলুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনের কারণে সরকারের ভেতরের বাইরে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এরদোগানকে কোনঠাসা করার জন্যই এ আন্দোলন হচ্ছে। বিশেষ করে বিরোধী দলগুলো এ আন্দোলনের ফসল নিজেদের ঘরে তোলার চেষ্টা করছে। বিক্ষোভে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি।
সাধারণ একটি ছাত্র বিক্ষোভ হিসেবে শুরু হলেও এটি রূপ নিতে পারে এরদোগান পতনের আন্দোলনে। অন্তত বিরোধী দলগুলোর এমনই আশা। এমনটাই জানিয়েছেন তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আনাদলু এজেন্সির চিফ রিপোর্টার সরোয়ার আলম। তার সঙ্গে কথা বলে সাজানো হয়েছে এ বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন-কেন এই বিক্ষোভ? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গত সপ্তাহে নিয়োগ প্রাপ্ত নতুন রেক্টরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। কিন্তু কেন? তার নিয়োগে কি দুর্নীতি হয়েছে? তার বিরুদ্ধে কি টাকা আত্মসাৎ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ধর্ষণ, যৌন হয়রানির মতো গুরুতর একটি অভিযোগও নেই। তাহলে কেন এই বিক্ষোভ? এ বিষয়ে ই-মেইল বার্তায় তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আনাদলু এজেন্সির চিফ রিপোর্টার সরোয়ার আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, তার দোষ মাত্র একটি। তিনি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ছিলেন। এক সময় এরদোয়ানের একে পার্টি থেকে সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন পাওয়ার জন্য প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যদিও পরে নমিনেশন পাননি। কিন্তু এই রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তিনি এখন ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। বিক্ষোভরত ছাত্রছাত্রীদের দাবি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করবেন। সরকার সমর্থিত শিক্ষকদের নিয়োগ দিবেন। সরকারি ঘরনার শিক্ষকরা বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবেন, ইত্যাদি। অর্থাৎ তিনি শিক্ষাদানের চেয়ে রাজনৈতিক মূল্যবোধকে বেশি মূল্যায়ন করবেন। সরোয়ার আলম বলেন, তিনি (বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর) আসনে বসার পর কী করবেন তা এখনই বলা মুশকিল। হয়তো উপরের বিষয়গুলোর সবকটিই করবেন, হয়ত ওইগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি করবেন। কিন্তু ওইগুলোর কোনোটিই না করে একেবারে ফেরেশতা হয়ে থাকবেন, তা বলা যাবে না। তার কার্যক্রম দেখার জন্য হয়ত আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে, যদি ততদিনে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য না হন। কিন্তু বিক্ষোভ এখনও চলছে। বিরোধী দল ছাড়াও এই আন্দোলনের সমর্থনে অন্য অনেক শহরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল করছে। তাদের দাবি, বিদ্যাপীঠগুলোকে রাজনীতিমুক্ত রাখার। খুবই যুক্তিযুক্ত একটি দাবি। কিন্তু আসলে তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি কখনও রাজনীতিমুক্ত ছিল? আনাদলু এজেন্সির চিফ রিপোর্টার সরোয়ার আলম আরও বলেন, তুরস্কের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যখন হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসা হয়েছিল। মেডিকেল, আইন, প্রকৌশলী বিভাগসহ বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি থেকে হাজার হাজার মেয়েকে শুধু হিজাব পরার কারণে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাদের ভবিষ্যতকে অন্ধকার করে দেয়া হয়েছিল। তখন কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, এর রেক্টর ও শিক্ষকরা রাজনীতি-নিরপেক্ষ হয়ে ওই ছাত্রীদের পক্ষে কথা বলেছিলেন? না, বলেননি। বরং ছাত্রীদের বিপক্ষে গিয়ে তখনকার রাজনৈতিক শক্তি এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে একই বুলি আওরিয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান ক্ষমতায় আসার পরে কত শিক্ষক যে ক্লাসে তাকে সরাসরি গালি দিয়েছে তার কি ইয়াত্তা আছে? ২০০৭ সালে যখন ইস্তান্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়ছিলাম তখন সব চেয়ে বড় বড় প্রফেসররা ক্লাস শুরু করতেন এরদোয়ানকে গালি দেওয়ার মাধ্যমে আর শেষ করতেন তার দলের গোষ্ঠী উদ্ধার করে। কত রেক্টর এবং শিক্ষক যে চাকরি ছেড়ে প্রধান বিরোধী দলের সংসদ সদস্য, দলীয় প্রধানের উপদেষ্টা হয়েছেন তার কি হিসেব আছে? তাদের মধ্য থেকে কতজন আবার চাকরিতে ফিরে এসেছেন তার খবর কে রাখে?
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তুর্কি সাংবাদিক সরোয়ার আলম আরও বলেন, আমি ২০০৭ সালে আঙ্কারায় এসেছিলাম কয়েকদিনের জন্য। এখানে বিখ্যাত তানদোয়ান মাঠের পাশেই একটা ছাত্রদের বাসায় উঠেছিলাম। একদিন রোববার বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে দেখি বিশাল মিছিল যাচ্ছে। মিছিলটি ছিল আব্দুল্লাহ গুলকে একে পার্টির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসাবে ঘোষণার বিরুদ্ধে। প্রধান বিরোধী দলের মিছিল।
বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মিছিল যাচ্ছিল “ডেমোক্রেসি মিটিং”-এ যোগ দিতে। একটি স্লোগান ছিল এমন-‘তুরস্ক সেক্যুলার রাষ্ট্র, সেক্যুলারই থাকবে’। তিনি বলেন, আঙ্কারায় অবস্থিত মিডল ইস্ট টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের পক্ষ থেকে সব শিক্ষার্থীকে এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় যে এই রাজনৈতিক জনসভায় যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক।
নিজের দেখা তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে সাংবাদিক সরোয়ার আলম বলেন, ২০০৮ সালে তুরস্কের সব রাজনৈতিক দল মিলে সংবিধানে পরিবর্তন নিয়ে আসে।
আর সেই সঙ্গে হিজাব পরার ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও উঠে যায়। উচ্চশিক্ষা কাউন্সিল থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরা ছাত্রীদের প্রবেশের অনুমতি দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়। আমাদের ক্লাসে দুটি মেয়ে ছিল যারা বাইরে হিজাব পরত কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সময়ে হিজাব খুলে মাথায় পরচুল পরে প্রবেশ করত। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার খবর পেয়ে পরের দিন ওরা হিজাব পরে ক্লাসে আসে। গার্ডরা কেউ বাধাও দেয়নি। ক্লাসেও ঢুকেছে। একজন ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন।
ওদের দুইজনকে হিজাব পরা দেখে তো রেগে আগুন! জানতে চাইলেন ওরা কারা? কেন তার ক্লাসে এসেছে? মেয়ে দুটি বুঝানোর চেষ্টা করল যে ওরা এই ক্লাসেরই ছাত্রী। হিজাবের উপরে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় ওরা হিজাব পরে এসেছে।
“তিনি বললেন, আমি মানি না ওই নিয়ম। তোমাদের সরকার করছে। আমার কী? এটা আমার ক্লাস, এখানে আমার আইন চলবে। তোমরা বেরিয়ে যাও। হিজাব পরে কোনদিন আমার ক্লাসে আসবে না। ”
কয়েকজন ছাত্র তাদের পক্ষ নিয়ে শিক্ষিকাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন। বের করে দিলেন ওদের ক্লাস থেকে। দুটি মেয়ের জীবনের প্রথম স্কার্ফ পড়ে ক্লাস করার আনন্দ এভাবেই কান্নায় পরিণত হয়েছিল সেদিন।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.