লাইলাতুল বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত
অচিরেই আসছে আমাদের মাঝে ১৫ শাবানের পুণ্যময় রজনী। যাকে আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুল বারাত’ বলা হয়। ফারসিতে ‘শবে বরাত’ ও হাদিসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে ইরশাদ করেন, ‘হে নবী আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনা মাফ করে দেবেন। তিনি ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।’ সূরা জুমার : ৫৩।
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) আমাকে উদ্দেশ করে বলেন, হে আয়েশা! তুমি কি জানো, আজ রাত কী? হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি তো জানি না, দয়া করে বলুন। মহানবী (সা.) বললেন, আজ রাতে আগামী বছরে যেসব বনি আদম জন্মগ্রহণ করবে এবং যারা মৃত্যুবরণ করবে, তাদের তালিকা লিপিবদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে বান্দাদের আমলনামা মহান আল্লাহর কাছে প্রকাশ করা হয়।
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যখন তোমাদের কাছে শাবানের মধ্যরাত (শবে বারাত) উপস্থিত হবে, তখন তোমরা সেই রাতটি জাগ্রত থাকো (নামাজ পড়ে, কোরআন তিলাওয়াত করে, তসবি পড়ে, জিকির করে, দোয়া করে) এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। কারণ, এ রাতে মহান আল্লাহ সূর্যাস্তের পর থেকে ফজর পর্যন্ত দুনিয়ার আসমানে তাশরিফ আনেন এবং তিনি ঘোষণা করেন, আছে কি এমন কোনো ব্যক্তি যে, তার গুনা মাফের জন্য আমার কাছে প্রার্থনা করবে? আমি তার গুনাসমূহ মাফ করে দেব। আছে কি এমন কোনো রিজিক প্রার্থনাকারী, যে আমার কাছে রিজিক প্রার্থনা করবে? আমি তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেব। আছে কি এমন কোনো বিপদগ্রস্ত, যে আমার কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চাইবে? আমি তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করব। এভাবে পূর্ণরাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা হতে থাকে এবং বান্দাদের ওপর রহমত বৃষ্টির মতো নাজিল হতে থাকে। ইবনে মাজাহ।
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, রসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
ওই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে, শিরকি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যাপক রহমত, মাগফিরাত ও সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত থাকে।
যদি শবে বরাতের ব্যাপারে অন্য কোনো হাদিস নাও থাকত, তবুও এ হাদিসটিই এ রাতের ফজিলত ও মর্যাদা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট হতো। তদুপরি ১০ জন সাহাবি থেকে শবে বরাতের ফজিলত, মর্যাদা ও আমল সম্পর্কে হাদিস বর্ণিত রয়েছে। ফাতহুল কাদির, ইসলাহি খুতুবাত।
হজরত আলা ইবনে হারিস (রহ.) থেকে বর্ণিত। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রসুল (সা.) নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হয় তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তখন তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা বা ও হুমায়রা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, তা নয়, ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা দেখে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজি (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.) ভালো জানেন। রসুল (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। আল্লাহতায়ালা অর্ধ শাবানে তাঁর বান্দাদের প্রতি নজর দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। বায়হাকি।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। মহানবী (সা.) বলেন, আমি এক রাতে মহানবী (সা.)-কে বিছানায় পেলাম না। তাই আমি অত্যন্ত পেরেশান হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। খুঁজতে খুঁজতে দেখি, তিনি জান্নাতুল বাকির মধ্যে মহান আল্লাহর প্রার্থনায় মগ্ন। তখন তিনি আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! আমার কাছে হজরত জিবরাইল আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আজ রাত হলো নিসফে শাবান (অর্থাৎ লাইলাতুল বারাত)। এ রাতে আল্লাহতায়ালা অধিক পরিমাণে জাহান্নামবাসী লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। এমনকি কালব বংশের বকরিগুলোর লোম সমপরিমাণ গুনাগার বান্দা হলেও। তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ।
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ১৫ শাবান (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে, তখন তোমরা রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনে রোজা রাখো। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহতায়ালা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোনো রিজিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দেব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। ইবনে মাজাহ, বায়হাকি।
মনে রাখতে হবে, ইবাদত করতে হবে একাকী, নির্জনে। তবে কোনো ঘোষণা ও আহ্বান ছাড়া এমনিতেই কিছু লোক যদি একত্রিত হয়ে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে। একে অন্যের আমলে ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হওয়া যাবে না। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.