বাংলাদেশে সৌদি খেজুর চাষ
খেজুর—যাকে আরবিতে বলা হয় ‘তুমুর’। সৌদি আরবে এর নানা জাত রয়েছে। বাংলাদেশেও খেজুরের বেশ চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে শতভাগ আমদানির মাধ্যমে। তবে সম্প্রতি এ দেশেও বাণিজ্যিকভাবে সৌদি আরবের খেজুরের চাষ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায়ও উন্নত জাতের খেজুর চাষ সম্ভব। কয়েক বছর আগে থেকেই এ দেশে খেজুর চাষ শুরু করেছেন কয়েকজন চাষি। এ ক্ষেত্রে তাঁরা অনেকটা সফলও হয়েছেন। লাভজনক হওয়ায় বর্তমানে অনেকেই ঝুঁকছেন খেজুর চাষের দিকে।
গাজীপুরের পিরুজালী ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম বাদল। তিনি খেজুর চাষের পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন নার্সারিও। যেখানে খেজুরগাছের চারা বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। যারা খেজুর চাষাবাদে আগ্রহী, তাদের কাছে চারা বিক্রির সঙ্গে প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন বাদল। তাঁর নার্সারির নাম ‘সৌদি ডেট পাম ট্রিস ইন বাংলাদেশ’।
নজরুল ইসলাম জানান, ২০১৪ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে ১৮টি চারাগাছ সংগ্রহ করে ১০ কাঠা জমিতে প্রথমে বাগান শুরু করেন তিনি। নাম দেন ‘সৌদি ডেট পাম ট্রিস ইন বাংলাদেশ’। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে তিনটি, দুবাই থেকে ১০টি, ভারত থেকে দুটি ও কুয়েত থেকে তিনটি চারা সংগ্রহ করেন নজরুল। এতে তাঁর ব্যয় হয়েছে প্রায় সাত লাখ ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে আড়াই একর জমিতে ছোট, বড় ও মাঝারি মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার চারাগাছ রয়েছে। যেগুলো আগামী পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে ফলন আসবে।
নজরুল ইসলাম আরো জানান, এ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে তিনি দুই হাজার চারাগাছ সংগ্রহ করেছেন। আর বাকি চার হাজার গাছ বিদেশ থেকে উন্নত মানের খেজুর এনে সেগুলোর বীজ থেকে চারা উৎপাদন করেছেন।
বর্তমানে নজরুলের বাগানে বড় ১১টি ও মাঝারি আকারের প্রায় ৩০০টি গাছে খেজুর ধরেছে। তাঁর বাগানে ছয়টি জাতের খেজুর চারা রয়েছে। এগুলো হলো আজওয়া, আনবারা, সুক্কারি, রুথান, বারহি ও মরিয়ম। আগামী দুই বছরের মধ্যে ১৫টি জাতের খেজুর চারা তাঁর বাগানে থাকবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
নজরুল বলেন, ‘প্রথম বছর পাওয়া খেজুরের স্বাদ এবং মান দুটোই ছিল ভালো। তা ছাড়া খেজুরের আকারও ছিল ভালো। যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো ফলন হয়েছে।’ গাছের পরিপক্বতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলন বাড়বে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, “বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় খেজুরগাছের বাগান হচ্ছে। যেসব চারাগাছ রোপণ করা হয়েছে, তার বৃদ্ধিও ভালো। সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে ভালো ফলন আসবে। বাংলাদেশে যে মানের খেজুর আমরা পেয়ে থাকি, তা ‘সি’ গ্রেডের। আর ‘এ’ গ্রেডের খেজুর যা আসে, তার দাম অনেক বেশি। যা সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।”
জানতে চাইলে নজরুল জানান, তাঁর বাবা মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমান দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। তিনি খেজুর বাগানের দেখাশোনা করতেন। সেখানে কাজ করার সুবাদে খেজুরের চাষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এক যুগের বেশি সময় খেজুরের চাষ পদ্ধতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে এ বিষয়ে তাঁর দক্ষতা অনেক বেশি। খেজুর চাষের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলে তাঁর বাবাই তাঁকে উৎসাহ দেন। প্রথমে বাবার কাছ থেকে এবং জ্ঞানেন্দ্র নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করেন তিনি।
খেজুরগাছ ১০০ বছরের বেশি সময় ফলন দেয়। আর এ ক্ষেত্রে খরচও কম। জৈব সার প্রয়োগই বাগানের প্রধান যত্ন। জৈব সার হিসেবে গোবরের পাশাপাশি রাসায়নিক সার পটাশ ও টিএসপি প্রয়োগ করতে হয়। সাধারণত সৌদিতে খেজুরগাছে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে ফুল আসে এবং জুলাই-আগস্টে ফল পেকে যায়।
খেজুর প্রধানত চারটি পর্যায়ে পাকানো হয়। সেগুলো কিমরি (কাঁচা), খলাল (পূর্ণাঙ্গ, ক্রাঞ্চি), রুতাব (পাকা, নরম), তুমুর (পাকা, সূর্যে শুকানো) নামে পরিচিত। গাছে ফল আসার জন্য সচরাচর তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদনের উপযোগী খেজুরগাছে ফল আসতে সাত থেকে দশ বছর সময় লেগে যায়। পূর্ণাঙ্গ খেজুরগাছে প্রতি মৌসুমে গড়ে ৮০ থেকে ১২০ কিলোগ্রাম (১৭৬ থেকে ২৬৪ পাউন্ড) ফল পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদ রেজা বলেন, ‘আমি কয়েকবার নজরুলের খেজুর বাগান পরিদর্শনে গিয়েছি। খেজুর বাগানের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময়। এ ক্ষেত্রে মাতৃগাছ থেকে শাখাকলম পদ্ধতির মাধ্যমে চারা নির্বাচন করতে হবে। তাতে ফলনের সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। বীজ থেকে চারা উৎপাদন করলে অনেক পুরুষ গাছ হতে পারে, যেগুলো ফলন দেবে না।’
মাসুদ রেজা আরো বলেন, ‘খেজুর চাষের সম্ভাবনা বা সফলতা এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এরই মধ্যে দেশের মাটিতে খেজুর কীভাবে উৎপাদন সম্ভব, তা গবেষণা করছেন। বিষয়টি এখন আমাদের কাছেও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।’
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.