বাংলাদেশের এফএম রেডিওতে সংবাদের প্রতি অনাগ্রহ কেন?
বাংলাদেশে বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশনের বাণিজ্যিক সম্প্রচারের প্রায় এক যুগ পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় তারা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে যেমন গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পেরেছে। সে অনুপাতে সংবাদের ক্ষেত্রে পারেনি।ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা অদিতি পাল তার অফিস থেকে বাসায় আসা যাওয়ার পথে গাড়িতে এফএম রেডিও শুনে থাকেন।সেখানে সবসময় প্রাধান্য পায় গান, না হয় বিনোদন-ভিত্তিক অন্যান্য অনুষ্ঠান। কোথাও সংবাদ শুরু হলে তিনি বেশিরভাগ সময়ই চ্যানেল বদলে দেন।প্রতিদিনের যানজট থেকে ফুরসত পেতে বিনোদনকেই বেছে নেন তিনি।
মিস পাল বলেন, "এই জ্যামের মধ্যে আমরা একটু এন্টারটেইন হতে চাই। আর নিউজের আপডেট সব মোবাইলেই পাওয়া, তাও আবার ছবি ভিডিওসহ। অনেক সময় বাসা থেকে বের হওয়ার আগে টিভিতেই দেখা হয়ে যায়।" অন্যদিকে ঢাকার ফ্রিল্যান্সার আরমান উল হক নিয়মিত এফএম রেডিও শুনলেও সেখানে প্রচারিত নিউজের প্রতি তার তেমন একটা আগ্রহ নেই।প্রচারিত প্রতিবেদন ও খবর উপস্থাপনায় নতুনত্ব না থাকাকে প্রধান কারণ বলে তিনি মনে করেন, "অনলাইনের সব নিউজ পোর্টালে প্রতিনিয়ত নিউজ আপডেট হয়। যেটা রেডিওতে হয়না। একই খবর রিপিট হয়। আবার রেডিও নিউজের প্যাটার্ন সবগুলোর একই রকম, কোন নতুনত্ব নাই। চেঞ্জ নাই। খুব একঘেয়েমি লাগে।"
২০০৬ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশন হিসেবে রেডিও টুডে যাত্রা শুরু করে।প্রায় এক যুগে এখন এফএম রেডিও স্টেশনের সংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮টিতে।
এরমধ্যে মাত্র পাঁচটি রেডিও স্টেশন নিয়মিত সংবাদ প্রচার করে থাকে। তারমধ্যে অন্যতম হল রেডিও এবিসি।তারা সংবাদ-ভিত্তিক এফএম রেডিও হওয়ার লক্ষ্যে সম্প্রচার শুরু করলেও শ্রোতাদের আগ্রহ না থাকায় তারা সংবাদ কমিয়ে বিনোদনের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে।এ ব্যাপারে রেডিও এবিসির অনুষ্ঠান প্রধান এবং বার্তা সম্পাদক গাজি শারমিন বলেন, "আমরা যে রকম সাড়া পাব ভেবেছিলাম,একটা নিউজ স্টেশন হিসেবে সেই সাড়াটা পাচ্ছিলাম না।এছাড়া আমাদের কাছে শ্রোতাদের যেসব চিঠি বা ম্যাসেজ আসতো, সেখানে সবারই অভিযোগ যে আমাদের এতো নিউজ কেন থাকে। সবাই শুধু গান শুনতে চায়।"
পরে রেডিও এবিসি কর্তৃপক্ষ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের রেডিও লিসেনিং টাইম পর্যবেক্ষণ করে দেখে যে যখনই তাদের খবর শুরু হয়, তখন বেশিরভাগ মানুষই তাদের চ্যানেল বদলে ফেলে।এমন অবস্থায় কয়েক ধাপে তারা খবরের সংখ্যা ও সময় কমিয়ে আনে।মিসেস শারমিন বলেন, "এখন যেটা হয় যে মানুষ মোবাইলে অনলাইন নিউজ পড়তে অনেক বেশি ইউজড টু হয়ে গেছে। এখন আর রেডিওতে কেউ খবর শুনতে চায়না। সবাই গান শুনতে চায়।"
সংবাদ প্রচার করা দুটি রেডিও ছাড়া আর কারো আলাদা বার্তা বিভাগ নেই। সেক্ষেত্রে তারা অন্যান্য সংবাদমাধ্যম সংগ্রহ করে শ্রোতাদের মাঝে তা প্রচার করে থাকে।সেই সঙ্গে দক্ষ জনবল না থাকায় শ্রোতাদের এম এফের সংবাদের সঙ্গে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানান একসময় এফএম রেডিওর বার্তা বিভাগে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি।
বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, "বেশিরভাগ এফএম রেডিওতে যে নিউজগুলো দেয়া হয়, সেগুলো খুব একটা অথেনটিক না। আমি নিজে দেখেছি যে অফিসের ছাদে গিয়ে গুগল ম্যাপ দেখে ট্রাফিক আপডেট দিচ্ছে।অথচ তারা শ্রোতাদের বলছে যে তাদের প্রতিনিধি সরাসরি রাস্তা থেকে সব জানাচ্ছে।"এছাড়া একটি বার্তা বিভাগ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়, সে তুলনায় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে তেমন খরচ নেই।আর্থিক ব্যয় কমিয়ে আনতে দক্ষ সংবাদকর্মী নিয়োগ না করাকেও বড় কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুযায়ী গত বছর এফএম রেডিওর শ্রোতার সংখ্যা তার আগের বছরের চাইতে ২৪ শতাংশ বাড়লেও সেই আগ্রহ জুড়ে বিনোদন-ভিত্তিক অনুষ্ঠানের প্রাধান্যই বেশি।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের মতে, এফএম বিনোদনের ক্ষেত্রে যেভাবে শ্রোতাদের আকর্ষণ করতে পেরেছে নিউজের ক্ষেত্রে তেমনটা পারেনি।
মিস্টার ফেরদৌস বলেন, "এফএম রেডিওর একটা ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে যে তারা একটা বিনোদন, গান, হাসি-ঠাট্টার মাধ্যম।এ কারণে সংবাদের মতো সিরিয়াস বিষয়ের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমটি তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সংবাদের জন্য মানুষ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেই যায়।এফএম রেডিওর ক্যারেক্টার একটা পারসেপশন তৈরি করেছে যে, এফএম রেডিও মানেই বিনোদন, সংবাদ নয়।"
এফএম রেডিও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল নগর-ভিত্তিক তরুণ প্রজন্মের খোরাক মেটাতে।সেক্ষেত্রে খবর প্রচারের ক্ষেত্রে তাদের আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার নতুন উপায় খোঁজা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
সূত্র- বিবিসি
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.