অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারানোর পর শুরু করেছিলেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলন।
সেই দুর্ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন? কখন শুনেছিলেন?
ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন নিহত হয়েছিলেন ১৯৯৩ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায়।তার মৃত্যুকে ঘিরে সেদিন সারাদেশে আলোড়ন উঠেছিলো যেমন তেমনি সেই ঘটনায় পাল্টে গেছে স্বামী ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবন।এরপর থেকে গত প্রায় আড়াই দশক ধরে তিনি চালাচ্ছেন নিরাপদ সড়কের সংগ্রাম।বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, "যাদের ভালোবাসায় আমি ইলিয়াস কাঞ্চন তাদের বাঁচাতে যদি আমি জিরো হয়ে যাই তাতে আমার কিছু যায় আসেনা"।
এমন ভাবনা থেকেই শুরু করলেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন যা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো।তার মতে, "পরিবহন সেক্টরে যারা আছে তাদের মধ্যে তখন বদ্ধমূল ধারণা ছিলো যে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে মানুষের কিছু করার নেই"।এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে শুরু করলেন সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে তার সংগ্রাম।
Image captionইলিয়াস কাঞ্চন
স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেকে ভেবেছেন অভিনয় আর করবেন কি-না। আশেপাশে যারা ছিলেন তাদের দিক থেকে নানা মত এসেছে। তারও মনে হচ্ছিলো হয়তো অভিনয় করা যাবেনা কারণ বাচ্চারা তখনো ছোট।এতদিন পর এসে প্রাপ্তি কি? উত্তরে মিস্টার কাঞ্চন বলেন, "কিছু প্রাপ্তি হয়েছে- ফোরলেন, ডিভাইডার দেয়া, একমুখী চলাচল, হাইওয়ে পুলিশ, নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা- এসব হয়েছে"।তবে হতাশাও আছে এ কারণে যে সড়ক দুর্ঘটনা এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।"শ্রমিক সংগঠনগুলো, তারা এখনো তাদের নিজেদের কথা ভাবে," বলছিলেন তিনি।
জাহানারা কাঞ্চনের দুর্ঘটনার সময় কোথায় ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন
ইলিয়াস কাঞ্চন বিবিসি বাংলাকে জানান যে তিনি তখন বান্দরবনে একটি সিনেমার শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন। "শুটিং করতে দ্বিতীয়বারের মতো গিয়েছিলাম। এর আগে একবার শুটিং করেছিলাম বান্দরবনে। তখন এসে বলেছিলাম দেখবা দেশটা কত সুন্দর। দ্বিতীয়বার ছবির সময় স্ত্রীকে বললাম চলো যাবা"। কিন্তু বাচ্চাদের পরীক্ষার কথা ভেবে তখন সাথে যাননি জাহানারা কাঞ্চন ও যদি কদিন পরেই ফোনে জানালেন তিনি যাবেন। "আমি গেলাম ১০ই অক্টোবর। আর ১৭ই অক্টোবর সে ফোন করে বললো তোমার জন্য সুখবর আছে। আমি আসছি। আমি খুবই আনন্দে ছিলাম যে ওরা আসছে"।
Image captionবহু ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি
এরপর যেদিন তার স্ত্রী সন্তান রওনা দিলেন তাদের সাথে একই মাইক্রোবাসে এটিএম শামসুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরাও ছিলো এবং মাইক্রোবাস চালকও ছিলো পূর্বপরিচিত।
"এর আগেও আমরা সিলেটে গেছি। ড্রাইভার আমাদের পরিচিত ছিলো। পরে জানতে পারলাম। ড্রাইভার আগের রাতে অন্য জায়গায় ডিউটি করেছে। সারারাত গাড়ি চালিয়ে সকালে আমার বাসা থেকে স্ত্রী-বাচ্চাদের নিতে বান্দরবান রওনা দেয়"। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন তার স্ত্রী সেবার নিজে বিস্কুট বানানো শিখেছিলো। "নিজের হাতে আমার জন্য বিস্কুট বানিয়েছিলো। কিন্তু সেটি আমি আর খেতে পারিনি"। ঘটনার বিবরণ দিয়ে মিস্টার কাঞ্চন বলেন, " ড্রাইভার জোরে চালাচ্ছিলো। আমার স্ত্রী বারবার সাবধান করছিলো। এক পর্যায়ে চালক উল্টো বলতে শুরু করলো। চালকের পেছনের দিকে একেবারে পেছনের সিটে বসেছিলেন আমার স্ত্রী। দুর্ঘটনার সময় চালক মাইক্রোবাস ঘুরানোর চেষ্টা করলে ট্রাক সরাসরি এসে আমার স্ত্রী বরাবর আঘাত করে"।
স্ত্রীর দুর্ঘটনার খবর কিভাবে শুনেছিলেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন জানান তখন তিনি বান্দরবানে সিনেমার শুটিংয়ে।"যে সময় দুর্ঘটনা হয় সে সময় বান্দরবানের আকাশ একদম পরিষ্কার ছিলো। ঠিক মূহুর্তের মধ্যে মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিলো"। তিনি বলেন, "এর মধ্যেই একটা ফোন আসলো। আমাদের শুটিংয়ের কাছে ওখানে একটি টাওয়ার ছিলো। ওখানে একটি ফোনটি ছিলো। তখন মোবাইল ছিলোনা। টাওয়ারের ফোনটিতে কল এসেছিলো আমার হোটেল থেকে। ওরা আমাকে খবর দিলো যে হোটেল থেকে আমার ফোন আসছে"।
Image captionজাহানারা কাঞ্চন
তখন মিস্টার কাঞ্চন ভাবছিলেন হঠাৎ ফোনের কারণ কি হতে পারে? "গিয়ে ফোন ধরলাম। হোটেল ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে বললো আপনার পরিবার আসার কথা ছিলো। আপনি ঘাবড়াবেন না। গাড়ীটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ওনারা অতটা না, মোটামুটি ভালো। আপনি শুটিং প্যাক আপ করে চলে আসুন"। ফোন রেখে সেখান থেকে শুটিং স্থলে ফেরার পথে নানা ভাবনা আসছিলো তার মনে। নিজেও আগে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিয়ে সিঙ্গাপুরেও চিকিৎসা নিয়েছিলেন। "ভাবছিলাম হয়তো ওদের নিয়ে সিঙ্গাপুর যেতে হতে পারে। যেহেতু শুটিং প্যাক আপ করতে বলেছে তার মানে সিরিয়াস কিছু হবে"।
তারপর তিনি যখন শুটিং ইউনিটের কাছে ফিরলেন তখন অন্যরা তাকে দেখেই বুঝলো যে সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। "সবাই বুঝে গেলো। আর এজন্য বলি সবসময় অভিনয় করা যায়না। তারা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পরিচালককে বললাম শুটিং প্যাক আপ করে দিতে হবে"।ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন হোটেলে যখন ফিরেন ততক্ষণে অনেকেই জেনে গেছে যে তার র স্ত্রী মারা গেছে কিন্তু তাকে সেটি জানানো হয়নি।
"আমি আসরের নামাজ পড়লাম। সবাই তাগাদা দিচ্ছিলো যে তাড়াতাড়ি চলেন। রওনা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় দুর্ঘটনার গাড়িটা দেখলাম। দেখেই মনটা শূন্য হয়ে গেলো। পরে যখন হাসপাতালে গেলাম দেখলাম বাচ্চা দুটো কাঁদতে কাঁদতে কেমন যেনো হয়ে গেছে"। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, "এটিএম ভাইও বসে আছে বিধ্বস্ত হয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম জাহানারা কোথায়? এটিএম ভাই বললো তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। তখন আমি চিৎকার করলাম"।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন, "উপন্যাসের মতোই আমার জীবন। অনেক উপন্যাস পড়তাম। শরৎচন্দ্রের বই। জীবনকে বিভিন্নভাবে দেখতে চেয়েছিলো সে (স্ত্রী)। মানুষের চাওয়া পূরণ হয়না। শরৎচন্দ্রের গল্পে বিয়োগান্তক বিষয় বেশি থাকে। ঘটনাবহুল আমার জীবন।"
Image captionস্ত্রী সন্তানদের সাথে ইলিয়াস কাঞ্চন
চলচ্চিত্রে এসেছিলেন জীবনকে দেখার জন্য
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন চলচ্চিত্রে এসেছিলেন জীবনকে দেখার জন্য।"ভাবছিলাম অভিনেতা হলে চরিত্রগুলোকে উপভোগ করতে পারবো। ডাক্তার বা অন্য কিছু হলে একটাই হতাম। কিন্তু অভিনেতারা সব চরিত্রে থাকতে পারে। এটা চেয়েছিলাম মনে প্রাণে"।সেই অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবনের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেলো ১৯৯৩ সালের সেই দুর্ঘটনা।অভিনেতা ইলিয়াস হয়ে গেলেন বাংলাদেশের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্বে।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.