ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক কেন ব্যর্থ হয়েছিলো?
একাত্তরের মার্চ মাস ছিলো আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল, উত্তেজনায় ভরপুর। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যপট। একদিকে নির্বাচনে জিতে আসা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গড়িমসি, অন্যদিকে দেশব্যাপী প্রতিরোধ-সংগ্রাম।এমনি এক প্র্রেক্ষাপটে সংকট সমাধানের কথা বলে দৃশ্যপটে এলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ঢাকায় শুরু হলো ইয়াহিয়া-মুজিব শীর্ষ বৈঠক।
কিন্তু ১৬ই মার্চ থেকে ২৪শে মার্চ পর্যন্ত আলোচনায় সময় গড়িয়ে গেলেও সমাধান মিললো না। উল্টো ২৫শে মার্চের রাত থেকে হামলা শুরু করলো পাকিস্তানি বাহিনী।
কিন্তু সংকট নিরসনে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা কেন ব্যর্থ হলো? আর আদতে পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে আলোচনার এই উদ্যোগ কি সমস্যার সমাধান নাকি সময় ক্ষেপনের জন্য ছিলো?
১৬ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবনে বৈঠকে বসলেন ইয়াহিয়া-মুজিব। রুদ্ধদ্বার বৈঠক। বৈঠকে দুই শীর্ষ নেতা ছাড়া আর কেউ নেই। বৈঠক চললো প্রায় আড়াই ঘণ্টা।বৈঠকের বিষয়বস্তু তখনো অজানা।বৈঠক শেষে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানান, "আলোচনা দুই-এক মিনিটের ব্যাপার নয়, যথেষ্ট সময় প্রয়োজন। তাই আলোচনা আরো চলবে।" পরদিন ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে একের পর এক প্রশ্ন হলেও সেসব এড়িয়ে যান শেখ মুজিব।দ্বিতীয় দিনের রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে শেখ মুজিবকে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছিলো বলে রিপোর্ট করে ইত্তেফাক।আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোন জবাব দেননি।তবে তিনি জানান, আলোচনার মধ্যেই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
এভাবে আরো চার দিন ইয়াহিয়া-মুজিব শীর্ষ বৈঠক চলে। আলোচনা হয় সংবিধান নিয়েও। তবে কোন সমাধান আসেনি।অবশ্য এই আলোচনায় সমাধান অসম্ভব ছিলো বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।তিনি বলছিলেন, "কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন দলিল কিন্তু আমরা কখনো পাইনি। পাকিস্তানিরা মূলত: আলোচনার একটা ভান করেছিলো। শাসনতন্ত্র নিয়েও কথা বলেছিলো। তবে বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই ৬-দফার ভিত্তিতে আলোচনা এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।"
একদিকে যখন আলোচনা চলছে, তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শিপিং করপোরেশনের জাহাজে করে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সৈন্য আনার খবর প্রকাশ হয়।রংপুর, সৈয়দপুর ও জয়দেবপুরে অসহযোগ আন্দোলনে থাকা সাধারণ মানুষের ওপর সেনাসদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।২৪শে মার্চ এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ জানায়, তাদের পক্ষ থেকে সকল বক্তব্য উপস্থাপন শেষ। এখন প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পালা।তবে প্রেসিডেন্টের সে ঘোষণা আর আসেনি।
ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের মতে, বঙ্গবন্ধু আলোচনায় সংবিধান কেমন হবে সে বিষয়ে ছয় দফার উপরই গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।তেইশ তারিখেই এ বিষয়ে একটি খসড়া হস্তান্তর করা হয় ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের কাছে।চব্বিশ তারিখে চূড়ান্ত বিবৃতি কী হবে সেটা আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোন করে জানানোর কথা ছিলো পাকিস্তানী পক্ষের।
কিন্তু সেই টেলিফোন আরে আসেনি। উল্টো ২৫শে মার্চ রাত থেকে হামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।ইয়াহিয়া, ভূট্টোসহ অন্যান্যরা এর আগেই ঢাকা ত্যাগ করেন।ফলে আলোচনা ব্যর্থ হলো। পাকিস্তানীরা রাজনৈতিক সমস্যার পরিবর্তে সামরিক সমাধানের পথে হাটলো।কিন্তু এটি কি আদৌ আলোচনা ছিলো? আর এর মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছাই বা কতটা ছিলো পাকিস্তানী সামরিক জান্তার?
ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলছিলেন, আলোচনার আড়ালে পাকিস্তানীরা মূলত: রণসাজে সজ্জিত হয়েছে।
ক্ষমতা হস্তান্তরেরও কোন ইচ্ছা পাকিস্তানীদের ছিলো না।একই মত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরীরও।তিনি বলছিলেন, "৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের পরই পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাঙ্গালির উপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া মানেই শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেয়া হবে না।"
শেখ মুজিব কেন এই সময়ক্ষেপনের আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন?
আফসান চৌধুরী বলছেন, এখানে শেখ মুজিবেরও কৌশল ছিলো। "তিনি আলোচনা অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু আলোচনা ভেস্তে যাওয়া, যেটা ইয়াহিয়া খানের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল, সেটাতে শেখ মুজিবের কোন দায় আসেনি। ফলে যখন মিলিটারির হামলা শুরু হলো, তখন খুব সহজেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন তিনি পেয়েছেন। যেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।"
একই মত ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনেরও। তিনি বলছিলেন, "শেখ মুজিবের লক্ষ্য ছিলো বিশ্ববাসীর কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দেয়া যে, তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নন। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ্য দলের নেতা। এবং তিনিআলোচনার মাধ্যেই সমস্যার সমাধান চান।কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন, পাকিস্তানি শাসকরা তার একটি শর্তও মানবে না। সেজন্য আগে থেকেই ৭ই মার্চের ভাষণেই তিনি বাঙ্গালিকে সশস্ত্র সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।"
সূত্র- বিবিসি
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.