মহা প্রতিভার এক নাম হানিফ সংকেত!
হানিফ সংকেত, দল-মত নির্বিশেষে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে একটি প্রিয় নাম। আপসহীন, স্পষ্টবাদী ও সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে সবাই তাকে ভালোবাসেন। এই গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব গত ৪০ বছর ধরে নিরলস প্রয়াস, সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে মিডিয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। অনবদ্য প্রতিভা ও কর্ম নৈপুণ্যে তিনি এখন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। উপস্থাপনার পুরনো ধারা ভেঙে ছন্দময় আধুনিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। তাকে বলা হয় এ দেশের মৌলিক অনুষ্ঠানের জনক। বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে তিনি যেমন নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন তেমনি আমাদের নাগরিক সচেতনতা এবং কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেও ভূমিকা রাখছেন আন্তরিকতার সঙ্গে। তার উপস্থাপিত ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানটি মান এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে টিভির সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে এখনো বিটিভিতে চলছে। ১৯৯৪ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে প্যাকেজ অনুষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে অনুষ্ঠানটি। এটাই ছিল বেসরকারিভাবে নির্মিত প্রথম প্যাকেজ অনুষ্ঠান। তাই বেসরকারিভাবে অনুষ্ঠান নির্মাণের পথপ্রদর্শকও বলা যায় তার নির্মিত ‘ইত্যাদি’কে। টেলিভিশনের মূলমন্ত্র অর্থাৎ শিক্ষা, তথ্য, বিনোদন। এই তিনটি বিষয় সব সময়ই খুঁজে পাওয়া যায় তার অনুষ্ঠানে। এতগুলো চ্যানেলের ভিড়ে তখন থেকে এখন পর্যন্ত এ অনুষ্ঠানটি টিভি গাইড ও পত্রপত্রিকার পাঠক জরিপ, বিবিসি জরিপ কিংবা হালের টিআরপি জরিপেও শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠানের মর্যাদা পেয়ে আসছে।
শেকড়ের সন্ধানের উদ্দেশ্যে ‘ইত্যাদি’কে স্টুডিওর চার দেয়াল থেকে বের করে নিয়ে গেছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রতœতাত্ত্বিক স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় স্থানে। তুলে ধরছেন সেসব স্থানের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য। সামাজিক আন্দোলনে হানিফ সংকেত এক অনন্য চরিত্র। গ্রামগঞ্জ থেকে তুলে নিয়ে আসছেন অসহায় সুপ্ত প্রতিভা। সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবীয় অঙ্গীকার ও মূল্যবোধের চেতনা থেকেই ‘ইত্যাদি’তে বিভিন্ন বিষয় ও আঙ্গিকে প্রতিবেদন প্রচার হয়ে আসছে নিয়মিত এবং সমাজে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ‘ইত্যাদি’র প্রতিবেদন যেমন বহুমুখী তেমনি সমাজ সচেতনতায়ও থাকে বহুমাত্রিকতা। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিবেদিতপ্রাণ মানুষের অনুসন্ধানে হানিফ সংকেত ছুটে বেড়ান সারা দেশে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তুলে আনেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রচার বিমুখ অনেক সৎ সাহসী, জনকল্যাণকামী, নিভৃতচারী আলোকিত মানুষদের। যাদের অনেকেই পরবর্তীতে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। (যেমন- নওগাঁর বৃক্ষপ্রেমী গহের আলী ‘ইত্যাদি’র প্রচার কল্যাণে ২০০৯ সালে পরিবেশ পদক পেয়েছেন। ‘ইত্যাদি’তে প্রচারের পর শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখা রাজশাহীর পলান সরকার ২০১১ সালে পান একুশে পদক। এছাড়াও ২০০০ সালে জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজেরও অভিষেক হয় ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে।) প্রতিবন্ধী মানুষদের কর্মমুখর জীবন যাতে কর্মবিমুখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে সে জন্য প্রতিবন্ধীদের নিয়েও ‘ইত্যাদি’তে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রচারিত হয়ে আসছে। ‘ইত্যাদি’র পাশাপাশি এই দীর্ঘ সময়ে তিনি নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। টেলিভিশন অনুষ্ঠানের বাইরেও তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন। ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে হানিফ সংকেত দীর্ঘদিন যাবৎ পরিবেশ বিষয়ক নানা প্রতিবেদন, কুইজ ও নাট্যাংশ প্রচারের মাধ্যমে দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছেন। বই ও বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা দেশের সব মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা হানিফ সংকেত করছেন ‘ইত্যাদি’র শুরু থেকেই। ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে তিনি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিতরণ করছেন হাজার হাজার বৃক্ষ ও বই। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি এসবই করছেন বিবেকের শুভ প্রেরণায় নিজের দায়বোধ থেকে।
নাট্যকার হিসেবেও হানিফ সংকেত যথেষ্ট দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেছেন। তার প্রতিটি নাটকই ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালায় প্রচারিত ও প্রশংসিত হয়েছে। সমাজ ও পরিবারের চিরায়ত মূল্যবোধ, যা হারিয়ে যেতে বসেছে এবং আমাদের চারপাশের অতি চেনাজানা বিষয়গুলো তিনি নাটকে তুলে ধরেন। অতি নাটকীয়তা নয়, সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বিনোদন এবং বক্তব্যের অপূর্ব সমন্বয়ে তিনি দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে চলেছেন তার প্রতিটি নাটক।
এটিএন বাংলার ইউরোপ অভিযান ও মূল সোগান ‘অবিরাম বাংলার মুখ’, দেশের প্রথম টেরিস্টেরিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল ‘একুশে টিভি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নির্মাণ ও উপস্থাপনা এবং এনটিভির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও মূল সোগান ‘সময়ের সাথে, আগামীর পথে’ প্রদানসহ তিনি বহু প্রশংসিত অনুষ্ঠানের নির্মাতা।
একজন সফল লেখক ও কলামিস্ট হিসেবে রয়েছে তার যথেষ্ট সুখ্যাতি। তার প্রতিটি লেখাই তাজা অথচ মজা। সুন্দর-স্বপ্রাণ। উপন্যাস ও রম্য রচনা মিলিয়ে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে ৩০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের সমাজ ও সামাজিক দ্বন্দ্বের স্বরূপ নিয়ে তিনি ভাবেন। বইয়ের লেখার মতো তার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তা উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত।
‘ইত্যাদি’র গ্রহণযোগ্যতা ও সামাজিক সচেতনতার কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানজনক টেলিভিশন চ্যানেল ARTE টিভিতে পৃথিবীর ৪০টি দেশের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর ওপর নির্মিত ‘World TV’ অনুষ্ঠানের জন্য ‘ইত্যাদি’ ও ‘হানিফ সংকেত’-এর ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রচারিত হয়। পৃথিবীর ৮টি দেশের প্রতিনিধি দলের উপরে নির্মিত ‘ইত্যাদি’র ‘ক্যাশ ফর বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনটি বেশ প্রশংসিত হয় যা বিশ্বের বেশ কটি দেশের টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। পৃথিবীর ২২টি দেশে প্রদর্শনের জন্য নেদারল্যান্ডসের মার্ক ভারকার্ক ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হানিফ সংকেতের যৌথ পরিচালনায় নির্মিত আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য চিত্র ‘ব্রিজিং টু ওয়ার্ল্ডস’-এর জন্য তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হন।
দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এছাড়াও সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ হানিফ সংকেত ২০১০ সালে পান রাষ্ট্রের মর্যাদাকর ‘একুশে পদক’। পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা ও প্রচার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ সালে পরিবেশ শিক্ষা ও প্রচার (ব্যক্তিগত) ক্যাটাগরিতে পান জাতীয় পরিবেশ পদক। এ জন্য তাকে বলা হয় ‘সমাজ ও পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী’। উল্লেখ্য, ‘দৈনিক প্রথম আলো’ আয়োজিত পাঠক জরিপে তিনি সর্বাধিক আটবার পুরস্কার পেয়েছেন। পরবর্তীতে নতুনদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি তাকে আর পুরস্কার না দেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানান। এছাড়াও একাধিকবার তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সংস্থা (বাচসাস), রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, কালচারাল জার্নালিস্ট ফোরাম, ঢালিউড অ্যাওয়ার্ডসহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার।
দেশের মতো বিদেশেও রয়েছে তার যথেষ্ট সুখ্যাতি। প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণে ১৯৮৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমণ করেন। এসব সফরে তিনি তুলে ধরছেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান।
গভীর পর্যবেক্ষণ রমণীয় বর্ণনা, ক্ষুরধার বুদ্ধিবৃত্তি তার উপস্থাপিত বিষয়গুলোকে করে তোলে জীবন্ত। বাস্তবতার অতলান্ত গভীরতায় কেড়ে নেয় দর্শক-পাঠকের মন। একজন হানিফ সংকেত জয় করেছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা। তার অনন্য কীর্তি-ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে হানিফ সংকেত কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন দেশের মূঢ় ম্লান মূক মানুষের। তার ‘ইত্যাদি’ হয়ে ওঠে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় ভরা আমাদের এই বাংলাদেশ। তার ওপর মানুষের প্রভাব হচ্ছে ভালোবাসার। আর এ ভালোবাসার টানেই দেশ-বিদেশের কোটি কোটি দর্শকের একটি চাওয়াÑ‘হানিফ সংকেত আমাদের জন্য-আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন যুগ যুগ ধরে।’
Bangladeshi Taka Converter
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.