বরিশালের ঐতিহ্যবাহী খাবার
বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেরই রয়েছে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট, রয়েছে নিজস্ব কিছু স্বকীয়তা। এই নিজস্বতা থাকে তার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনায়, অাচার ব্যবহার রীতিনীতিতে, পোশাক-অাশাকে ও খাবার-দাবারে যেগুলো ঐ অঞ্চলের অালাদা পরিচয় বহন করে এবং অন্য অঞ্চলের অধিবাসীদের মাঝেও ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের অালাদা করে উপস্থাপন করে। অাজ অামরা সেরকম কিছু নিয়েই কথা বলবো। অাজ কথা বলবো বরিশালের কিছু খাবার নিয়ে যেগুলো বরিশালবাসীদের নিকট জনপ্রিয় এবং সমাদৃত।
মলিদা
বরিশাল অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী ও আকর্ষণীয় খাবার হচ্ছে মলিদা। মলিদা ব্যতীত ইদ বা যেকোনো উৎসব বরিশালের মানুষদের কাছে যেন ঠিকমতো জমেই ওঠে না। উৎসবমুখর পরিবেশে বরিশালের মানুষদের মলিদাটা যেন চাই-ই চাই। দীর্ঘদিন ধরে এ জনপদের প্রিয় খাবারের তালিকায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছে মলিদা। এ অঞ্চলের ছেল-বুড়ো সবাই বড় দূর্বল এই মলিদার কাছে। বরিশালের এই ঐতিহ্যবাহী ও আকর্ষণীয় এই মলিদার মাঝে একটি অাধিপত্যের ছাপ রয়েছে। তবে বরিশালের বাইরে অনেকেই আমরা মলিদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই।
আর তাই হুট করে কোথাও গিয়ে মলিদা নামটি বললে অনেকেরই বোঝার কথা না, এটি খায় না মাথায় নেয়। যদি বরিশালের কেউ সেখানে থাকে তবে সে-ই বুঝবে জিনিসটা কী। বাকীরা সবাই ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে। নামই যেখানে অজানা সেখানে প্রস্তুত প্রণালী অবশ্যই জানার কথা না। তাই মলিদা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করছি। মলিদা দুই রকম। চিড়ার মলিদা ও মুড়ির মলিদা।
উপকরণ
চিড়া অথবা মুড়ি, কোড়ানো নারিকেল, দুধ, এক কাপ পোলায়ের চাল ও আদা কুচি অথবা বাটা।
প্রস্তুত প্রণালী
আকর্ষণীয় এই মলিদা তৈরি করতে আপনাকে যা করতে হবে তা হলো, প্রথমেই আপনি নারিকেল কুড়িয়ে নিন। এবার কোড়ানো নারিকেলগুলো আলাদা পাত্রে রেখে দিন। এরপর পোলায়ের চাল ভাল করে বেটে পেস্ট করে নিন। চালগুলো খুব মিহি করে বাটতে হবে।খেয়াল রাখতে হবে, কোনো দানা যেন না থাকে। আপনি চাইলে পোলায়ের চালগুলো ব্লেন্ডার করে নিতে পারেন। সেখানেও খেয়াল রাখবেন, যেন চালের কোনো দানা না থাকে। সব যেন একদম মিহি হয়ে যায়। এবার দুধ উনুনে বসিয়ে ভাল করে জ্বাল করে নিন। দুধের মধ্যে চিনি মিশিয়ে নেবেন। দুধটা জ্বাল করার পর একে বেশ কিছুক্ষণ ঠাণ্ডাস্থানে রেখে দিন।
কেননা মলিদা ঠাণ্ডা খেতেই ভাল লাগে। দুধ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে তাতে চালের পেস্ট মিশিয়ে দিন। চালের পেস্টটা মিশিয়ে একটু নেড়ে দিন যেন দুধের সাথে মিশে যায়। চালের পেস্ট মেশানোর পর এতে নারিকেল দিয়ে দিন।নারিকেলগুলো ভাল করে মিশিয়ে ফেলুন যেন দুধ, চাল ও নারিকেল একে অপরের সাথে ভালভাবে মিশে যায়। অতঃপর এতে সামান্য আদা বাটা বা কুচি ঢেলে একটু লবণ ছিটিয়ে নাড়তে থাকুন। ব্যস আপনি তৈরি করে ফেললেন বরিশালের ঐতিহ্যবাহী খাবার মলিদা। এবার পরিবেশনের পালা। তবে হ্যাঁ, পরিবেশন সময় আপনার পছন্দের উপর নির্ভর করবে মলিদাটা মুড়ির হবে নাকি চিড়ার হবে।
আপনি যদি মুড়ির মলিদা করতে চান তবে মলিদা গ্লাসে ঢেলে, তার উপর মুড়ি ছড়িয়ে দিন আর চিড়ার করতে চাইলে ভাজা চিড়া ছড়িয়ে দিন। ব্যস, প্রস্তুত আকর্ষণীয় মলিদা। তবে আপনি মুড়ি অথবা চিড়া কখনোই আগে ছিটাবেন না। এতে এগুলো নরম হয়ে যাবে এবং খেতে ভাল লাগবে না। খাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে মুড়ি অথবা চিড়া মিশিয়ে নিন।
বিসকি
বরিশালের আরেকটি জনপ্রিয় খাবারের নাম বিসকি। অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ নাম শুনে হা হয়ে থাকলেও বরিশালের মানুষ বিসকির নাম শুনলেই জিভে জলের অস্তিত্ব অনুভব করে। কারণ তারা বিসকির স্বাদের সাথে পরিচিত। বরিশালের সর্বস্তরের মানুষের মাঝেই রয়েছে বিসকির প্রচলন।
উপকরণ
চাল, নারিকেলের গুঁড়ো, গুঁড় এলাচ, তেজপাতা, দারুচিনি ও লবণ।
প্রস্তুত প্রণালী
বিসকি তৈরি করতে চাইলে প্রথমেই আপনাকে যেটা করতে হবে তা হলো, চাল ভেজে নিতে হবে। কড়াইতে হলকা লবণ চালের সাথে মিশিয়ে চালগুলো ভেজে নিন। ভাজা হয়ে গেলে চাল ভাজাগুলো প্রায় এক ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন।
এক ঘণ্টা পর চুলোয় বসানো পাত্রে একটু তেল দিয়ে তাতে দারুচিনি, এলাচ ও তেজপাতা ছেড়ে দিন। এরপর গুঁড়গুলো ঢেলে দিন। গুঁড়গুলো আগুনের আঁচে গলে গেলে তাতে ভিজিয়ে রাখা চাল ভাজাগুলো দিয়ে দিন এবং নাড়তে থাকুন। বেশ কিছুক্ষণ নাড়ার পর এতে নারিকেল দিয়ে দিন।
এবার নারিকেল ভাল করে মিশিয়ে দিয়ে পানি ঢেলে দিন। এবার নেড়েচেড়ে বেশ কিছুক্ষণ জ্বাল করতে থাকুন। জ্বাল করার পর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন। কিছুক্ষণ পর ঢাকনা তুলে যখন দেখবেন পানির আধিক্য একেবারেই কমে গিয়েছে, বুঝে নেবেন তৈরি হয়ে গিয়েছে বিসকি। এবার পরিবেশন করুন পরিজন ও প্রিয়জনদের।
হোগল
বরিশালের আরেকটি পরিচিত খাবারের নাম হোগল। হোগল সাধারণ হোগলার ফুলের গায়ে লেগে থাকা পাউডার থেকে তৈরি হয় বলে একে হোগল বলা হয়। বরিশালে হোগলার পাতার চাষ করা হয় এবং এ অঞ্চলের তৃণমূল কৃষকদের নিকট এটি একটি উপার্জনক্ষম শস্য হওয়াতে বরিশালে হোগলা পাওয়া দূর্লভ কিছু না। সেই সূত্রেই হয়তো এখানে হোগলের প্রচলন।
উপকরণ
চাল ভাজা, দুধ, হোগল, চিনি, লবণ।
প্রস্তুত প্রণালী
প্রথমে ভাজা চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। ঘণ্টাখানেক চাল ভাজা পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর একে দুধ ও পানি সহ উনুনে চাপিয়ে দিন। এই মিশ্রণটি সেদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত জ্বাল করতে থাকুন। একসময় চাল সেদ্ধ হয়ে এতে দুধ ও চিনি ঢেলে দিন। দুধ চিনি ঢেলে দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়ুন। পানি কমে এলে এতে হোগল ঢেলে দিন। হোগল ঢেলে দিয়ে নাড়তে থাকুন যেন সব উপকরণগুলো একে অপরের ছোঁয়া পায়। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে নামিয়ে আনুন উনুন থেকে। ব্যস তৈরি হয়ে গেল বরিশালের প্রচলিত খাবার হোগল। এবার আপনি তা পরিবেশন করুন আপনার খাওয়ার টেবিলে অথবা বন্ধুদের আড্ডায়। চমকে দিন সবাইকে। জানিয়ে দিন আপনার রন্ধনশৈলী সম্বন্ধে।
Bangladeshi Taka Converter
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.