হোটেল লেকশোরের করাল গ্রাসে গুলশানের শত কোটি টাকার প্লট
ভূমিদস্যু, দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ন্যস্ত হলে প্রশাসন কিংবা বিচার বিভাগও তারা কলঙ্কিত করে ফেলে। এমনই একটি ঘটনা সর্বোচ্চ আদালতের গোচরীভূত হয় এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে গ্রাসকৃত সম্পত্তি সর্বোচ্চ আদালত মুক্ত করেন এবং ভূমিদস্যুদের টুঁটি চেপে ধরেন।আলোচ্য রিপোর্টে সর্বোচ্চ আদালতের মহানুভবতা ও দূরদর্শিতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে।বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদে সুপ্রিমকোর্টকে যে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যুগে যুগে বিচারপতিরা তাদের বিচারিক দূরদর্শিতা ও সাহসিকতার মাধ্যমে তার প্রয়োগ করে অনেক অবিচার হতে দেশ ও মানুষকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু, সর্বোচ্চ আদালত প্রদত্ত আদেশ লঙ্ঘন করে ভূমিদস্যুরা নানা ধরনের অসাধু পন্থায় মানুষের সম্পত্তি গ্রাস করছে।
অভিজাত গুলশানের হোটেল লেকশোর শত কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল ও গ্রাস করা সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের লঙ্ঘন। কিন্তু, এ অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করার যেন কেউ নেই। রাজউক কিংবা প্রশাসন চোখ বন্ধ করে থাকে যেন, কারও কোনো দায়িত্ববোধ নেই। আজকের রিপোর্টটি মূলত ‘একটি প্লটের আত্মকাহিনী’।অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিজাত গুলশান আবাসিক এলাকার ৪১ নম্বর সড়কের ৪৩ নম্বর প্লটটি বর্তমানে হোটেল লেকশোর মালিকপক্ষ বেআইনিভাবে দখল করে ব্যবহার করছে। সাবেক বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিশেষ আস্থাভাজন ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্লটটি হাতিয়ে নেন। ফালুচক্র নিম্ন আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে পানির দামে প্রায় ১ বিঘা সম্পত্তি ১ কোটি টাকা নামমাত্র মূল্যে নিলামে ক্রয় করে। সব আইনগত প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে মাত্র ৭ দিনের মধ্যে নিলাম বহাল, বায়নানামা-দখলনামাসহ সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, হোটেল লেকশোরের সঙ্গে একটি বেআইনি বায়না করে ফালুচক্র। কিন্তু রাজউকের অনুমোদন না পাওয়ায় অগ্রযাত্রা থেমে যায়। পরে ওই সম্পত্তির দাবিদার রীনা হুমায়ুনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত যোগসাজশি নিলাম নিম্ন আদালত হতে আপিল বিভাগেও বাতিল হয়। হোটেল লেকশোরের মালিকপক্ষ সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত ধরনা দিয়ে পরাজিত হয়। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ নিলাম চূড়ান্তভাবে বাতিল করার পরও লেকশোর কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে প্লট অবৈধভাবে দখল করে ব্যবহার করছে।সরেজমিন জানা যায়, হোটেল লেকশোরের অবৈধ দখলে থাকা প্লটের অবস্থান হোটেল লেকশোরের উল্টোদিকে। ওই প্লটে লেকশোর কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে গাড়িপার্কিং তৈরি করে ব্যবসা করছে। এছাড়াও টিন শেড ঘর তৈরি করে কর্মচারী ও নিরাপত্তা কর্মীদের আবাসন ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। অবাক বিষয় হলেও সত্য যে, অভিজাত এলাকায় অবস্থিত সম্পত্তিতে লেকশোর কর্তৃপক্ষ গরুর খামার তৈরি করে দুধ সংগ্রহ ও অর্থ উপার্জন করছে। এতে করে আশপাশের বসতবাড়ির পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। গরুর খামার থাকায় গরুর পয়োবর্জ্য একদিকে পরিবেশ দূষণ করছে, নোংরা ময়লা-আবর্জনায় অভিজাত এলাকার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে এবং মশার উৎপাতে পথচারী ও এলাকার বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
প্রকাশ্যে অবৈধভাবে প্লট দখল করে অভিজাত গুলশানের পরিবেশ বিনষ্ট করলেও পরিবেশ অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো নির্বিকার রয়েছে। এর নেপথ্য কারণ হচ্ছে, হোটেল লেকশোর মালিকপক্ষ সবাইকে ম্যানেজ করে তাদের অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।সরেজমিন আরও জানা যায়, হোটেল লেকশোরের অবৈধ ও পরিবেশ বিপর্যয়কারী কর্মকাণ্ড গুলশানের বাসিন্দা এবং বিদেশি কূটনীতিকদের সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিচ্ছে। এত সবের পরও কেউ হোটেল লেকশোরের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। সাধারণ জনগণের দাবি হচ্ছে, হোটেল লেকশোরের করাল গ্রাস থেকে প্লটটি দখলমুক্ত করা এবং প্রকৃত মালিককে দেয়া। এছাড়া সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী প্লটটি নিলাম বিক্রয়ের পূর্বে আদালতের হেফাজতে নিয়ে সংরক্ষণ করা জরুরি।
এ অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে ১৩ এপ্রিল হোটেল লেকশোরে যান যুগান্তর প্রতিবেদক। তখন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা যুগান্তর প্রতিবেদককে বলেন, হোটেল কর্তৃপক্ষের কেউ হোটেলে নেই। তারা হোটেল লেকশোর ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এন আহমেদ মাসুদের একটি কার্ড দেন। টেলিফোনে ওই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় যুগান্তর প্রতিবেদকের। তিনি যুগান্তর প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই প্লট দখলে রাখার বিষয়ে তাদের পক্ষে আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে।’ এ সংক্রান্ত প্রমাণপত্র সরবরাহ করার অনুরোধ জানালে তিনি বলেন, ‘হোটেল লেকশোরের মালিক দেশের বাইরে রয়েছেন, পরবর্তী সপ্তাহের শুরুতে যোগাযোগ করলে প্রমাণপত্র সরবরাহ করতে পারবেন।’ ওই কর্মকর্তার কথা অনুযায়ী পরে যোগাযোগ করা হলে হোটেল লেকশোরের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এন আহমেদ মাসুদ বলেন, ‘এ বিষয়ে হোটেল লেকশোর আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নয়।’
মালিকানা বিরোধ : হোটেল লেকশোরের দখলে থাকা প্লটটি ডিআইটি ১৯৬২ সালের ৩০ মার্চ জনৈকা হাবিবা সুলতানা জায়েদী বরাবরে বরাদ্দ প্রদান করে। আর এ প্লটের দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করা হয় ১৯৬৩ সালের ২৭ মার্চ। এর অনুকূলে ৪৪৫৯ নম্বর স্থায়ী লিজ দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দেয়া হয়। প্লটটি হাবিবা সুলতানা জায়েদী ভোগদখল করাকালীন ১৯৭৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হলফনামা সম্পাদন করে তার একমাত্র কন্যা মমতাজ বেগম বরাবরে দান করেন। আর ওই দানের সমর্থনে ১৯৭৮ সালের ২১ এপ্রিল প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একটি হলফনামা সম্পাদন করেন, যার নম্বর ২২০৮।
মমতাজ বেগম ওই সম্পত্তিতে বাড়ি নির্মাণের জন্য অগ্রণী ব্যাংক হতে ১৯৭৭ সালের ১৯ জুলাই ৩ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে ২০টি কিস্তি বাবদ ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৯২ টাকা পরিশোধ করেন। অবশিষ্ট ১৩টি কিস্তি বাবদ সুদসহ ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা অপরিশোধিত থাকে। মমতাজ বেগম দানপত্র মূলে মালিক হয়ে বিল্ডিং নির্মাণপূর্বক ভোগদখলে থাকাকালীন নগদ টাকার আবশ্যকতা হওয়ায় জনৈক রীনা হুমায়ুনের সঙ্গে ১৯৮৬ সালের ২৭ এপ্রিল ১৮৮৯ নম্বর রেজিস্ট্রি বায়না দলিল সম্পাদন করেন। আর সম্পত্তির দেখাশোনা ও বিক্রয় কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য রীনা হুমায়ুনের স্বামী জনৈক হুমায়ুনকে আমমোক্তার নিয়োগ করেন। এর মূল্য নির্ধারিত হয় ২৫ লাখ টাকা। তন্মধ্যে রীনা হুমায়ুন বায়না বাবদ ১১ লাখ ৬০ হাজার টাকা প্রদান করেন এবং ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা বাকি থাকে। যেটা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশন সময় প্রদেয়। তবে মমতাজ বেগম ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ গোপন রাখেন।
পরে মমতাজ বেগম কবলা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় রীনা হুমায়ুন চুক্তিপ্রবল মূলে দলিল রেজিস্ট্রি পাওয়ার জন্য ঢাকার ১ম সাবজজ আদালতে দেওয়ানি মোকদ্দমা নং ২৮০/১৯৮৭ দায়ের করেন। যেটা পরবর্তীতে দেওয়ানি মোকদ্দমা নং ১৮/৯৩ হিসেবে বিচার হয় এবং ২০০০ সালের ৩০ অক্টোবর দুই তরফা সূত্রে ডিক্রি হয়।
পক্ষান্তরে মমতাজ বেগম রীনা হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বায়না বাতিলের জন্য দেওয়ানি মোকদ্দমা নম্বর ১৯/৯৩ দায়ের করে। যেটা বিজ্ঞ আদালত ২০০১ সালের ৩০ জানুয়ারি খারিজ করে দেন। চুক্তি প্রবলের মামলা এবং চুক্তি বাতিলের মামলা উভয়ে একত্রে শুনানি হয়। রীনা হুমায়ুন ডিক্রিপ্রাপ্ত হন ও মমতাজ বেগম হেরে যান। এর বিরুদ্ধে মমতাজ বেগম হাইকোর্ট বিভাগে এফ.এ নং ২৫৩/২০০০ এবং এফ.এ নম্বর ১৯২/২০০১ আপিল দায়ের করেন। যেটা আপিল শুনানির পর ২০০৫ সালের ৯ এপ্রিল খারিজ হয়ে যায়। এরপর মমতাজ বেগমের দাখিলকৃত সি.এম.পি নম্বর- ১৮৪/২০০৫ ও ১৮৫/২০০৫, আপিল বিভাগ ২০০৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর খারিজ করে দেন। ফলে রীনা হুমায়ুন চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করেন এবং মমতাজ বেগম হেরে যান। রীনা হুমায়ুন ডিক্রিজারি মোকদ্দমা নম্বর ০৩/২০০০ দায়ের করে বিক্রি টাকা ১৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ২০০১ সালের ২১ মে আদালতে জমা দেন। একই সঙ্গে কবলা দলিল সম্পাদনের জন্য প্রার্থনা করেন। মোকদ্দমাটি ১ নম্বর বাণিজ্যিক আদালত হতে বদলিপূর্বক ঢাকার ১ম সাব-জজ আদালতে দেওয়ানি ডিক্রি ৪/২০০৪ হিসেবে রেজিস্ট্রি হয়। ওই মামলায় রীনা হুমায়ুন আদালতের নির্দেশ মোতাবেক ২০০৬ সালের ২৭ জুনে খসড়া দলিল দাখিল করলে জারিকারক আদালত রাজউক থেকে সেল পারমিশন গ্রহণের নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মমতাজ বেগম আদালতে হাজির হয়ে লিখিতভাবে জানান যে, ওই সম্পত্তি ইতিমধ্যে নিলামে বিক্রয় হয়েছে। এরপর বেরিয়ে আসে নতুন ইতিহাস।
নিলামে প্রতারণা ও যোগসাজশ : তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মমতাজ বেগমের দাখিলকৃত ২০০৭ সালের ১৭ জুনে আপত্তিদৃষ্টে দেখা যায়, মমতাজ বেগম ১৯৭৭ সালের ১৯ জুলাই বাড়ি নির্মাণের জন্য অগ্রণী ব্যাংক, মহাখালী শাখা হতে ৩ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ২০টি কিস্তিতে ২ লাখ ১৩ হাজার ৭৯২ টাকা পরিশোধ করেন এবং সুদসহ ১৩ কিস্তি বাবদ ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা অপরিশোধিত থাকে। অগ্রণী ব্যাংক দীর্ঘদিন পর ১৯৮৯ সালের ৩১ মার্চ ১১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬৬ টাকা ৬০ পয়সা দাবি করে মমতাজ বেগম ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে ঢাকার বাণিজ্যিক আদালতে দেওয়ানি মোকদ্দমা নম্বর ৭৯/৮৯ মামলা করে। আর ১৯৯১ সালের ৯ জুন প্রাথমিক ডিক্রি লাভ করেন। পরে ৩ বছরের মধ্যে চূড়ান্ত ডিক্রি প্রস্তুতের জন্য আবেদন করেননি। ফলে ডিক্রিটি তামাদি বারিত হয়ে যায় এবং ১২ বছরের মধ্যেও ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এ কারণে ডিক্রি অকার্যকর হয়ে যায়।
আরও জানা যায়, ২০০৩ সালের পহেলা মে অর্থঋণ আদালত আইন- ২০০৩ কার্যকর হয় এবং ১৯৯০ সালের পুরাতন অর্থঋণ আইন বাতিল হয়। নতুন আইনের অধীনে চূড়ান্ত ডিক্রি প্রদানের বিধান রোহিত হয়। কিন্তু, অগ্রণী ব্যাংক তামাদির বিষয়টি বুঝতে পেরে নতুন আইনের বিধান উপেক্ষা করে ২০০৩ সালের ২৪ জুন একটি প্রতারণামূলক আবেদন দায়ের করে আদালতকে ভুল বুঝিয়ে একটি চূড়ান্ত ডিক্রি হাসিল করে। চূড়ান্ত ডিক্রি দেখিয়ে অর্থজারি মামলা ৪১৭/২০০৩ দায়ের করে এবং ওই মামলায় মোসাদ্দেক আলী ফালু ও নুরুল ইসলাম মনি বেআইনি ও যোগসাজশিভাবে প্রতারণামূলক নিলাম দরপত্র দাখিলপূর্বক ২০০৫ সালের ১৪ জুলাই আদালতে অনুচিত প্রভাব খাটিয়ে মাত্র ১ কোটি টাকায় ক্রয় করেন।
এদিকে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ওই নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি ২ নম্বর ঋণগ্রহীতা মো. সেলিম (মমতাজ বেগমের স্বামী) ইতিপূর্বে মারা যাওয়ায় তার ওয়ারিশদের পক্ষভুক্ত করার জন্য আনীত দরখাস্ত ২০০৫ সালের ১৪ জুলাই খারিজ করে নিলাম বিক্রয় অনুষ্ঠিত হয়। নিলাম ইশতেহার জারি না করে এবং ১৫ দিন পূর্বে নিলাম বিজ্ঞপ্তি বিজ্ঞ আদালতে দাখিল না করে আইনের বিধান লঙ্ঘন করে। ওই দিন নিলাম বিজ্ঞপ্তি দাখিলপূর্বক এককভাবে দরপত্র দাখিল করে বিচারক ও ব্যাংক অফিসারদের ওপর অনুচিত প্রভাব খাটিয়ে মোসাদ্দেক আলী ফালুগং নিলাম ক্রয় করে এবং সব প্রক্রিয়া ৭ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করে।
২০০৬ সালের ২৪ জুলাই নিলাম বহাল হয়, একই বছরের ২৬ জুলাই বায়নানামা প্রস্তুত ও স্বাক্ষর হয় এবং পরের দিন ২৭ জুলাই বায়নানামা রেজিস্ট্রি হয়। ২০০৬ সালের ৩০ জুলাই প্রতীকী দখল সম্পন্ন হয় এবং ৭ দিনের মধ্যে অস্বাভাবিক গতিতে সব কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে ৩ বছরেও শেষ হয় না। সেক্ষেত্রে মোসাদ্দেক আলী ফালুর ক্ষমতার দাপটে ৭ দিনে সম্পন্ন হয়েছে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীদের অভিমত, ‘বাংলাদেশের বিচারালয় ও সরকারি দফতরগুলো ফালুর অধীনে থাকত, তাহলে জনগণ কতই না উপকৃত হতো। আহারে ক্ষমতা... আহারে রাষ্ট্রশক্তি... আহারে জনগণের হাহাকার!’
বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে : বেআইনি নিলাম কার্যক্রম দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রীনা হুমায়ুন ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম-জেলা জজ আদালতে নিলাম বাতিলের জন্য দেওয়ানি মোকদ্দমা নম্বর ৯/২০০৮ দায়ের করেন। ওই মোকদ্দমা ২০১১ সালের ২৩ আগস্ট ডিক্রি হয় এবং আদালত উক্ত নিলাম কার্যক্রমকে নজিরবিহীন, জালিয়াতি, প্রতারণামূলক, যোগসাজশি ও বেআইনি ও বাতিল ঘোষণা করেন। ওই রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে অগ্রণী ব্যাংক এবং মোসাদ্দেক আলী ফালু চক্র হাইকোর্ট বিভাগের ফার্স্ট আপিল (এফ.এ) নম্বর ৮৫/২০১২ দায়ের করে; যেটা ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর খারিজ হয়ে যায়।
এ সংক্রান্ত বিষয়ে আপিল বিভাগে সি.পি নম্বর ২৬৯৬/২০১৪ দায়ের করলে আপিল বিভাগ প্রথমে আপিলের অনুমতি প্রদান করেন। এরপর সিভিল আপিল নম্বর ১৬৪/২০১৫ শুনানির পর ২০১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর খারিজ হয় এবং তর্কিত নিলাম বাতিল হয়। আপিল বিভাগ সম্পত্তিটি পুনরায় যথাযথভাবে নিলাম বিক্রয় করে রীনা হুমায়ুনকে তার পরিশোধিত ২৫ লাখ টাকা, ১৫ ভাগ সরল সুদসহ পরিশোধের নির্দেশ দেয়। আর আদালতে দাখিলকৃত টাকা উঠিয়ে নেয়ার অনুমতি দেন এবং সোলেটিয়াম হিসেবে রীনা হুমায়ুনকে আরও ২ কোটি টাকা প্রদানের নির্দেশ দেন এবং মমতাজ বেগম ও তার ওয়ারিশদের ২ কোটি টাকা পরিশোধসহ ব্যাংকের পাওনা টাকা ও নিলাম ক্রেতার পরিশোধিত ঢাকা ১০ ভাগ সরল সুদে পরিশোধের নির্দেশ দেন। এর পরের বিক্রি মূল্য সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য ঢাকার প্রথম অর্থঋণ আদালতকে নির্দেশ প্রদান করেন এবং এ সংক্রান্ত রিভিউ পিটিশন খারিজ হয়। এর ফলে মোসাদ্দেক আলী ফালু চক্র ওই সম্পত্তির চূড়ান্তভাবে অধিকার হারান। ফলে হোটেল লেকশোরের অবৈধভাবে দখলকৃত প্লট দখলমুক্ত হওয়া একান্ত আবশ্যক।
পুনঃনিলাম বিভ্রাট : আপিল বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক ঢাকার প্রথম অর্থঋণ আদালত পুনরায় নিলাম কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এতে হোটেল লেকশোরের মালিকপক্ষ নিলামে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর শুরু হয় নিলাম বিভ্রাট।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর ‘দৈনিক ঢাকার ডাক’ নামক কম প্রচার সংখ্যার একটি পত্রিকায় একটি যোগসাজশি ও প্রতারণামূলক নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হয়। তবে ওই তারিখের কোনো পত্রিকার কপি বাজারে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় যে, ওইদিন ঢাকার ডাকের অল্পসংখ্যক পত্রিকা প্রিন্ট করে নিলামের দিন চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি আদালতে হাজির করে। জনগণ যাতে নিলাম সম্পর্কে জানতে না পারে, সেজন্য এ কাজ করা হতে পারে। ওই পত্রিকায় কোনো অনলাইন কপি কিংবা প্রিন্ট কপি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও রীনা হুমায়ুন ও তার নিকটজন আদালতে উপস্থিত হয়ে নিলাম দরপত্র দাখিল করেন। এ দরপত্রে জনৈকা হুমায়রা খান ৬৬ কোটি টাকার ভুয়া দরপত্র দাখিল করেন। কারণ সে আর্নেস্ট মানি হিসাবে ১০ ভাগ জামানত বাবদ কোনো পে-অর্ডার দাখিল করেনি। তিনি ব্র্যাক ব্যাংকের চেক এবং সিআরপি-৪০৭৩৭৭৭, চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি দাখিল করেন। এটা অগ্রহণযোগ্য এবং বেআইনি। হোটেল লেকশোর মালিক কাজী তারেক শামস মাত্র ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকার নিলাম বিজ্ঞপ্তি দাখিল করেন। অপরদিকে, দাদা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ৬৫ কোটি ৫১ লাখ টাকার দরপত্র দাখিল করেন। এতে ১০ ভাগ জামানত বাবদ ৬ কোটি ৫৫ লাখ ১০ হাজার টাকার পে-অর্ডার দাখিল করেন তিনি। রীনা হুমায়ুন নিজে ৫০ কোটি টাকার দরপত্র দাখিল করেন এবং জামানত বাবদ ৫ কোটি টাকার পে-অর্ডার দাখিল করেন। আর সারিয়াত তাসরিন ৩০ কোটি টাকার দরপত্র দাখিল করেন এবং ১০ ভাগ জামানত বাবদ ৩ কোটি টাকার পে-অর্ডার দাখিল করেন।
আরও জানা যায়, বিচারক দরপত্র উন্মুক্ত করার পর হুমায়রা খানের দরপত্র বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয় এবং রীনা হুমায়ুনের পক্ষে আইনজীবী ওই দরপত্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং জামানতের কাগজ দেখতে চান। এ বিষয়ে কোনো জবাব না দিয়ে আদালত নেমে গেলে আইনজীবী আবেদন দিয়ে হুমায়রা খানের দরপত্র চ্যালেঞ্জ করেন। আদালত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না দিয়ে কালক্ষেপণ করেন। হুমায়রা খানের দরপত্র নন-রেসপনসিভ হওয়ায় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেসপনসিভ হিসেবে গণ্য হওয়ায় কথা এবং তিনি আদালতে সে মর্মে আবেদন করেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আদালত রহস্যজনক নীরবতা পালন করেন। পরে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি একটি আদেশ পাওয়া যায়। ওই আদেশে দেখা যায়, প্রস্তাবিত মূল্য প্রকৃত মূল্য থেকে কম বিবেচনাপূর্বক আদালত অপর্যাপ্ত মূল্যের অজুহাতে সমুদয় দরপত্র বাতিল করেন। এখানে বিজ্ঞ আদালত অত্যন্ত কৌশলে হুমায়রা খানের নামীয় দরপত্র সঠিক কিনা তা এড়িয়ে গেছেন। আর ২৮ ফেব্রুয়ারি পুনরায় নিলামের তারিখ নির্ধারণ করেন এবং রহস্যজনক কারণে অদ্যাবধি নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়নি। একটি নিলাম বিভ্রাট সম্পর্কে জনগণকে অপেক্ষা করতে হবে। রীনা হুমায়ুন দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিক সময় মামলা লড়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে জিতেও সুফল থেকে বঞ্চিত।
সংক্ষুব্ধ নাগরিকদের অভিমত, ‘বেআইনি নিলাম সর্বোচ্চ আদালতে বাতিল হলেও উক্ত নিলামের ফলভোগী হিসেবে শত কোটি টাকা দামের মূল্যবান সম্পত্তি হোটেল লেকশোর উপভোগ করে যাচ্ছে। আর আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে এরকম দখলদারিত্ব আর কতকাল চলবে? সত্যিই বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।’
সূত্র- যুগান্তর
সূত্র- যুগান্তর
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.