শবে-কদরের তাৎপর্য
শবে কদর (আরবি: لیلة القدر) আরবিতে লাইলাতুল কদর। এর অর্থ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুন’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হলো—ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা।ইসলাম ধর্ম অনুসারে, এ রাতে ইসলামের মহানবী, মুহাম্মদের অনুসারীদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তাই মুসলমানদের কাছে এই রাত অত্যন্ত পুণ্যময় ও মহাসম্মানিত হিসেবে পরিগণিত। কুরানের বর্ননা অনুসারে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটি মাত্র রজনীর উপাসনা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর মাহে রমজানে এই মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর মুসলিমদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে বলে তারা বিশ্বাস করে।
“নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে। শবে কদর সম্পর্কে আপনি জানেন কি? শবে কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতারা ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’’ (অনুবাদ: আওয়ারহলিকুরআন.কম)
শবে-কদর কিভাবে পেলাম তার ইতিকথা: একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) বনি ইসরাইলের ৪ জন আবেদের কথা বলেন, যারা ৮০ বছর পর্যন্ত নিরলসভাবে আল্লাহ পাকের ইবাদতে রত ছিলেন। ওই সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও আল্লাহ পাকের হুকুমের বরখেলাপ করেননি। উক্ত ৪ জন আবেদ হলেন, হযরত আইয়ুব (আ.), হযরত জাকারিয়া (আ.), হযরত হিজকীল (আ.) এবং হযরত ইউশা বিন নুন (আ.)।
রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম খুবই আশ্চর্যান্বিত ও বিচলিত হলেন যে তাদের পক্ষে এতো ইবাদত করা সম্ভব নয়। কারণ আখেরী নবীর উম্মত ৬০-৭০ বছরের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। কাজেই তাদের সমান বয়স না পাওয়ায় এতো ইবাদত করা সম্ভব নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক সূরা কদর নাজিল করে সাহাবায়ে কেরামকে সান্তনার বাণী শুনিয়ে ছিলেন।
আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘শবে কদরের ইবাদত এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও বেশি বরকতময় ও শ্রেষ্ঠ’’, এ রাতেই প্রথম কুরআন নাজিল হয়। এ রাতে হযরত জিব্রাইল (আ.) অগনিত ফেরেস্তা নিয়ে ধরাপৃষ্ঠে অবতরণ করে বিশ্ববাসীর জন্য অসংখ্য কল্যাণ ও প্রাচুর্য বিতরণ করেন। এ রাতে আল্লাহর মাহবুব বন্দারা অবর্ণনীয় আন্তরিক শান্তি অনুভব করেন। এ রাতে অবিরাম ধারায় আল্লাহ তায়ালার রহমত ও বরকত বিশ্ববাসী ও মুমিনদের অন্তরে নেমে আসে। আল্লাহ পাক অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করে থাকেন। তওবা কবুল হয়। আসমানের সমস্ত দ্বার খুলে দেওয়া হয়। এ রাতে গরম ও শীত কোনোটি বেশি অনুভূত হয় না। ফজর পর্যন্ত নক্ষত্র অটুট থাকে। সূর্য উদয়কালে প্রখরতা থাকেনা ও সূর্য উদয়কালে শয়তান উপস্থিত থাকে না।
অতএব, পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদরকে অনুসন্ধান করতে হয়। অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখ রাত সমূহে শবে কদর ঘটে থাকে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তুমি যদি চাও তোমাদের কবর নূরের দ্বারা উজ্জ্বল হোক, তা হলে শবে কদরের রাত্রে ইবাদত কর। যে ব্যক্তি শবে কদরের রাতকে জিন্দা রাখে, কেয়ামতের দিন তার দিল মুরদা হবে না। বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি শবে কদরকে জিন্দা রাখে, সে একশ’ বছর ইবাদত করার সওয়াব পাবে।
তবে, ২৭ রমজান শবে কদর ঘটার পক্ষে অনেকে মত প্রকাশ করেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ৭ সংখ্যার মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে: যথা- (১) আল্লাহ পাক আসমান বানিয়েছেন ৭টি (২) জমিনও সাত পরণ। (৩) সাফা ও মারওয়াতে সায়ী করতে হয় ৭ বার। (৪) কাবার তাওয়াফ করতে হয় ৭ বার। (৫) শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করতে হয় ৭ বার (৬) মানবকে সৃষ্টি করেছেন সাত পর্যায়ে। (এক) মৃত্তিকার সারাংশ (দুই) শুক্র (তিন) জমাট রক্ত (চার) মাংস পিণ্ড (পাঁচ) অস্থি পিঞ্জির (ছয়) অস্তিকে মাংস দ্বারা আবৃতকরণ (সাত) রূহ সংযুক্তকরণ (৭) কুরআনের কেরাত ৭ প্রকার। (৮) নামাজের সেজদাহ্ ৭টি অঙ্গ দ্বারা করা হয় (৯) দোযখের সংখ্যা ৭ (১০) কুরআনে পাকে আল্লাহ ৭ বার কসম খেয়েছেন। কুরআন শরীফের ৯৭ নং ‘‘সূরা কদর”- এ কদর শব্দটি ৩ বার বলা হয়েছে। এ সূরায় ‘‘লাইলাতুল কদর” লিখতে ৯টি অক্ষর লাগে। এ ৯ সংখ্যাটিকে উক্ত ৩ দ্বারা গুণ করলে ২৭ সংখ্যাটি দাঁড়ায়। উক্ত ৯৭ ও ২৭ সংখ্যা দুইয়ের মধ্যেও ৭ সংখ্যাটি সংযোগ হয়ে ৭ এর গুরুত্ব বহন করেছে।
অন্যান্য বড় বড় পবিত্র রাতের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু শবে কদরের তারিখ নির্ধারিত নেই। তাই রমজানের শেষ ১০ দিন বেজোড় রাতসমূহের মধ্যে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে হয়।
আমার কথা ছিল ৭ নিয়ে, তাই বলছি, ২০ এর সঙ্গে ৭ যোগ করলে ২৭ হয়। এজন আমার ধারণা, শবে কদরও রমজানের ২৭ তারিখ রাতে ঘটে থাকে।
হযরত উবাইদ বিন ওমর (রা.) বলেছেন, আমি ২৭ রমজান শবে কদরের রাত্রে সুর সাগরে জাহাজে চড়লাম। যখন সাগরের পানির স্বাদ গ্রহণ করি, তখন দেখি, পানি খুব মিষ্টি। আর জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। আর দেখলাম সমস্ত বৃক্ষ সেজদায় পড়ে আছে। শবে কদর যখন ঘটবে, তখন কিছু আলামত উপলব্ধি করা যায়। লাখ লাখ ফেরেশতা যারা নাজিল হয়েছেন তারা সব ইবাদতকারীর সঙ্গে মোসাফাহ্ করেন। তখন অন্তরে খুশ অনুভূত হয়। শরীরের লোম খাড়া হয়। চোখ দিয়ে অশ্রু বের হয়। তখন দোয়াও কবুল হয়।
তবে, হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সারা বছর জাগ্রত থেকে রাতে ইবাদত করবে, সে অবশ্যই শবে কদর লাভ করবে।
তাই, ওলামায়ে কেরামদের অভিমত হলো, রমজানের শেষ ১০ দিন হতে ইতেকাফ পালন করে যেন শবে-কদর তালাশ করা হয়।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.