দ্রৌপদী
দ্রৌপদী সম্ভবত পুরাণের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও বিতর্কিত নায়িকা। দ্রৌপদী (পঞ্চালী, কৃষ্ণা) পঞ্চাল রাজ্যের রাজা দ্রুপদের কন্যা। তাঁর গাঢ় গাত্রবর্ণের জন্যে তাঁর আরেক নাম কৃষ্ণা।পূর্বজন্মে দ্রৌপদী এক ঋষির কুটিরে বাস করতেন এবং সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন। শঙ্কর দেবতাকে অনুক্ষণ তপস্যা করতে করতে শঙ্করের আবির্ভাব ঘটে। শঙ্কর তাকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। দ্রৌপদী তখন তাঁর কাছে পরজন্মে সর্বগুণে গুণান্বিত স্বামী পাবার জন্য বর ভিক্ষা করেন। শঙ্কর যতবার তাঁকে বর দিতে চান ততবারই দ্রৌপদী একই কথা বলেন।পাঁচবার বলায় পরজন্মে দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী হয়।
পরজন্মে তাঁর স্বয়ংবর সভায় অর্জুন জলে প্রতিফলিত ছায়া দেখে তার অব্যর্থ তীর ধনুক দিয়ে ঝুলন্ত মাছের চক্ষু ভেদ করে প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে দ্রৌপদীকে বিবাহ করতে সমর্থ হন। যখন দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব বাড়ি আসে, বাইরে থেকে তারা জানায়, ‘মা, আমরা তোমার জন্যে ভিক্ষা করে এনেছি এক রমণীয় পদার্থ।’
ভেতর থেকেই কুন্তি বললেন, ‘যা এনেছ, পাঁচ ভাই ভাগ করে নাও।’ কুন্তি জানতেন না তাঁরা দ্রৌপদীকে নিয়ে এসেছেন।এদিকে দ্রৌপদীকে স্বয়ংবর সভায় দেখা অবধিই পাঁচ ভাই কামার্ত হয়ে পড়েছিলেন। মায়ের এই আদেশের পরে দ্রোপদির অমতে তখন যুথিষ্ঠিরের কথায় পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গেই দ্রৌপদীর বিয়ে হয়।
তবে পরবর্তীকালে ভীম আর অর্জুন দ্রৌপদী ছাড়াও আরো কয়েকটি বিয়ে করেন এবং প্রতি স্ত্রীর সঙ্গেই তাদের একটি করে পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। তাই দেখা যায়, দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামী ছিল দ্রৌপদীর ইচ্ছেয় নয়, পান্ডবদের মাতৃ-আজ্ঞা পালনের কারণে। অথবা পূর্বজন্মের বরের বিরোধিতা করলেন না কেন
দ্রৌপদী, তিনি কি জানেন না, স্বয়ংবর-সভায় যার গলায় মালা দেওয়া হয় কেবল তিনিই হন তাঁর স্বামী?
দ্রৌপদীর অবস্থা দেখে প্রতিভা বসু মন্তব্য করেন, দ্রৌপদী ‘যেন খেলার বল। একের কাছ থেকে (যাচ্ছে) অপরের কাছে।’ পাঁচ স্বামী ছাড়াও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ছিল দ্রৌপদীর। তাঁর বিপদের দিনে কৃষ্ণ বারবার এসে তাঁকে রক্ষা করেছেন। একবার উন্মুক্ত রাজসভাস্থলে দ্রৌপদীকে পণ রেখে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সঙ্গে হেরে গেলে দুঃশাসনের মাধ্যমে দুর্যোধন দ্রৌপদীর বস্ত্র খুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সকল পান্ডব ও কুরুদের সামনে, এমনকি তাঁর পঞ্চস্বামীর সামনে সেটা ঘটতে যাচ্ছে দেখে দ্রৌপদী তাঁর স্বামীদেরসহ তাঁর শ্বশুরালয়ের সকল গুরুজনকে তিরস্কার করেন তাঁরা অধর্মের পথে যাচ্ছে বলে। তিনি এই অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেননি।
দ্রৌপদীর এই বহুল আলোচিত বস্ত্র-হরণের ঘটনাটিকে গল্পকার মাহবুব সাদিক সমসাময়িক এক ধর্ষণের দৃশ্যে নান্দনিকভাবে ব্যবহার করে গল্পটি শেষ করেছেন এই বলে যে, ‘এ-কালের কোনো শাড়িই আর অন্তহীন নেই।’ এছাড়া কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে আরেকবার খুব সাহায্য করেছিলেন। পান্ডবরা তখন বনে, দুর্বাসা মুনি পান্ডবদের কুটিরে উপস্থিত হন তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মধ্যভোজনের জন্যে। দুর্বাসার মেজাজের জন্যে সকলে তাঁকে ভয় করে। দ্রৌপদীর ঘরে কণামাত্র খাবার রয়েছে। তাঁর অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ এসে সেই কণা থেকে সকলের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে উপাদেয় খাদ্য তৈরি করে দেন। দুর্বাসা খুশি হয়ে চলে যান। এবারো দ্রৌপদী তাঁর অসমর্থ ও নিশ্চল স্বামীদের তিরস্কার করেন তাঁদের কোনো ভূমিকা না রাখার প্রতিবাদে।
পাঁচ স্বামীর সঙ্গে যাতে শান্তিপূর্ণভাবে দ্রৌপদী বাস করতে পারেন, নারদ মুনি নিয়ম করে দেন, দ্রৌপদী এক বছর এক স্বামীর সঙ্গে থাকবেন। অন্য স্বামীরা তখন অপেক্ষা করবেন। এক বছর পর অগ্নির ভেতর দিয়ে গিয়ে পুনরায় পবিত্র ও
সতী হয়ে তিনি দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে থাকতে শুরু করবেন। এভাবে প্রতি স্বামীকে চার বছর অপেক্ষা করতে হবে এক বছর দ্রৌপদীর সঙ্গলাভের জন্যে। অর্জুন একদা এই নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে তাঁকে এক বছরের জন্যে ব্রহ্মাচার্যে যেতে হয়েছিল আরো দূর বনে। সেখানে গিয়ে অবশ্য অর্জুন ব্রহ্মাচার্যের বদলে আরো তিনখানি বিয়ে করেন - চিত্রাঙ্গদা,
সুভদ্রা (কৃষ্ণের বোন) ও উলুপীকে।
দ্রৌপদী সকল স্বামীকে শুধু শান্তিতে রাখেননি, সকলের আগে ঘুমথেকে উঠে সামান্য কিছু খেয়ে সারাদিন সমস্ত কাজকর্ম শেষে সকলের পরে শুতে যেতেন। তবে দ্রৌপদী একটা নিয়ম করে দেন তাঁর স্বামীদের, যা তাঁদের মেনে চলতে হয়। দ্রৌপদী জানতেন তাঁর স্বামীদের কারো কারো আরো স্ত্রী রয়েছে। কিন্তু দ্রৌপদীর নির্দেশে তাঁরা কেউ প্রাসাদে ঢুকতে পারতেন না। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতে হলে তাঁর স্বামীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে সেই স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে হতো। কৃষ্ণের সহোদরা অর্জুনের স্ত্রী সুভদ্রার বেলায় শুধু এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছিলেন দ্রৌপদী। পাঁচ স্বামীর মধ্যে অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর কিছুটা পক্ষপাতিত্ব থাকলেও ভীমই একমাত্র স্বামী যিনি স্ত্রীর বিপদের দিনে এগিয়ে এসে সাহায্য করেন।
বনবাসকালে রাজা বিরাটের স্ত্রী সুদেষ্ণার ভাই কীচক দ্রৌপদীকে জোর করে ভোগ করতে চাইলে দ্রৌপদীর অনুরোধে আর কেউ নয়, ভীম এসে কীচককে খুন করেন। রাজসভায় সকলের সামনে দ্রৌপদীকে জিম্মি রেখে পাশা খেলে যুধিষ্ঠির
হেরে গেলে দুর্যোধনের আজ্ঞায় দুঃশাসন দ্রৌপদীর কাপড় খুলতে উদ্যত হলে স্বামীদের ভেতর একমাত্র ভীমই বাধা দেন।
কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামার কাছে দ্রৌপদী স্বীকারকরেছেন, পাঁচজন স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখতে তাঁকে কতগুলো কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়। দ্রৌপদী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, বাস্তববাদী নারী। তিনি তাঁর প্রতি অন্যায় আচরণের জন্যে প্রতিশোধ চাইতেন, মুখ বুজে সহ্য করতেন না অবিচার।প্রতি স্বামীর সঙ্গে দ্রৌপদীর একটি করে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর পাঁচটি পুত্রকেই ঘুমন্ত অবস্থায় বধ করে অশ্বত্থামা। অশ্বত্থামার মা একজন ধর্মপ্রাণ নারী ও গুরু। সেই বিবেচনায় এবং পাঁচ পুত্রকে হারিয়ে নিজের শোকাতুর অবস্থা অনুধাবন করে সকলের পরামর্শ ও উপদেশ অগ্রাহ্য করে অশ্বত্থামাকে তিনি ক্ষমা করে দেন।দ্রৌপদী চান না তাঁর মতো করে আরেকটি মা এমন প্রচন্ড শোকে পান্ডুর হোক।
কল্পনায় অর্জুনের প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল দ্রৌপদী সেই চিঠিতে তীব্র প্রতিবাদ করেন স্বামীর ছলনা, এই দীর্ঘ বিরহ এবং তাঁর প্রতি অর্জুনের ঔদাসীন্যের জন্যে। ধর্মরাজযুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলায় পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছিলেন, মহাবীর অর্জুন শত্রুদমনের উদ্দেশ্যে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে সুরপুরে চলে যান।কিন্তু অস্ত্রশিক্ষার নাম করে সেখানে গিয়ে নানারকম ভোগবিলাসে মেতে ওঠেন অর্জুন। এর প্রতিবাদেই স্ত্রীর অধিকার নিয়ে লেখা তাঁর এই পত্রে বিরহী ও প্রতারিত দ্রৌপদীর মর্মবেদনা ও ঈর্ষা ফুটে ওঠে।
এছাড়া (২০১১ সালে)ভারতের রাজ্যসভার প্রাক্তন সদস্য জারলাগাদ্দা লক্ষ্মীপ্রসাদে (Yarlagadda Lakshmi Prasad) যিনি ২০০৩ সালে তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্যে ভারত সরকারের কাছ থেকে পদ্মশ্রী উপাধি পেয়েছিলেন, তেলেগু ভাষায় দ্রৌপদী নামে এক উপন্যাস লেখেন যেখানে তিনি তাঁর কল্পনায় দ্রৌপদীর যৌন আকাঙ্ক্ষা, পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা বিধৃত করেন। কর্ণের প্রতিও দ্রৌপদীর দুর্বলতা ছিল বলে ওই উপন্যাসে ইঙ্গিত রয়েছে। এই বছর ভারতের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার লাভ করেছে এই বই।
Bangladeshi Taka Converter
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.