‘ডোন্ট ডাই বিফোর ইউর ডেথ’
সার্স ভাইরাসে ২০০২ থেকে ২০০৩ সালে চীন ও হংকংয়ে প্রায় সাড়ে ৬০০ মানুষ মারা যায়। তখন উহান শহরে প্রথম সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। চীনে সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া অনেককে চিকিৎসা দেওয়া হয়, যাদের বেশির ভাগ উহানের নাগরিক। ২০১২ সালের এপ্রিলে মধ্যপ্রাচ্যে মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি-সিনড্রোম করোনাভাইরাস বা মার্স-করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত করা হয়। তখন ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য, জর্ডান, কাতার, সৌদি আরব, তিউনিসিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এই রোগ শনাক্ত হয়েছে। মার্স-করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশে ঝুঁকি ছিল, তবে এ নিয়ে তেমন কেউ আতঙ্কিত হয়নি। সন্দেহজনকভাবে অনেকের শ্বাসনালীর লালা পরীক্ষা করা হয় কিন্তু কারও শরীরে মার্স-করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়নি তখন। করোনা সার্স, মার্স এবং কোভিড-১৯ পৃথিবীতে এসেছে। সার্স এবং মার্সে বিশ্ব খুব একটা ক্ষতি হয়নি, যার কারণে বিশ্ব তেমন গবেষণা করেনি এর ওপর। তার মানে আমরা অতীতে সংকেত পেয়েছি করোনাভাইরাসের। এরপরেও তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এবার কোভিড-১৯ এসে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা যেমন বেড়েছে ঠিক তেমন করে পৃথিবীর অর্থনীতিকে পঙ্গু করতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে সারা বিশ্বের মানুষের মনে আতঙ্কের ঝড় বইয়ে দিয়েছে। এবারের করোনা ছোঁয়াচে রোগ, তাই সবাই ধরা খেয়েছে। তবে মরছে যারা দুর্বল এবং বয়স্ক। পৃথিবীর ক্ষমতাশীল ধনী দেশের বয়স্ক মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করার কারণে সব কিছু লকডাউন করা হয়েছে। সুইডেন ইউরোপের একমাত্র দেশ যেখানে এখনো লকডাউন নেই। তবে ৫০ জনের বেশি মানুষ একত্রিত হওয়া নিষেধ।
৭০ প্লাস বয়সের সর্দি জ্বরে আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। তাই ৭৮ বছর বয়সী আমাদের পারিবারিক বন্ধু মি. বেংটে (Bengt) ও আমার স্ত্রীর (মারিয়া) ৯০ প্লাস বয়সী বাবা-মা’কে নিয়ে বিপাকে পড়েছে। করোনার কারণে তাদেরকে আমার বাসায় আনতে পারছিনা। আবার আমরাও তাদের বাসায় যেতে পারছি না। কয়েকদিন আগে মারিয়া তার বাবা-মার সঙ্গে ভছা (Vasa) পার্কে আর আমি বেংটের সঙ্গে হগা (Haga) পার্কে দূরত্ব বজায় রেখে দেখা করেছি। স্মৃতিচারণে মি. বেংটে বললেন, ১৯১৮ সালে সুইডেনের রাজা পঞ্চম গুজতাভ (Gustav v)-এর ছেলে এরিক (২৯) স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসে মারা গিয়েছিলেন। ভাইরাসটি আমেরিকা থেকে এলেও তার নাম হয়েছিলো স্পান্সকা সুখা (Spanish flu)। এতে বিশ্বের প্রায় পাঁচ কোটিরও বেশি লোক মারা যায়। এর বেশির ভাগ ছিল অল্প বয়স্ক। এবারে করোনায় বেশি মারা যাচ্ছে ৭০ ঊর্ধ্ব মানুষ। সুইডেন আয়তনে বাংলাদেশের তিনগুণ হলেও বসতি এক কোটির বেশি নয়। জিডিপি (২০২০ ফেব্রুয়ারির জরিপ অনুযায়ী) পার ক্যাপিটা আয় ৪৬৩৩৬, আমেরিকা ৫৪৬১২ এবং অস্ট্রেলিয়ার ৪৬৯৪২ ইউএস ডলার।
ভ্রমণ পিপাসু সুইডিশরা সুযোগ পেলেই বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। অন্যদেরকেও সুইডেন ভ্রমণে উৎসাহিত করে। সুইডেনে প্রায় সব দেশের নাগরিকরাই বাসকরে। এখানে সাধারণ সর্দি-জ্বর ছাড়া তেমন কোনো সংক্রামক রোগ নেই। তবে ডিপ্রেশন বা স্ট্রেস একাকীত্ব ও অতি পরিশ্রম জনিত কারণে মানসিক অসুস্থতার কথা শোনা যায়। সংক্রামক রোগ এখানে যা দেখা যায় তার বেশির ভাগই বাইর থেকে আসা। যেমন এবারের করোনা এসেছে চীন থেকে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত এখানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজার। মারা গেছেন প্রায় ৪০০ জন।
সুইডিশ সরকার, রাজনীতিবিদ ও জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মনে করেন কঠোর পদক্ষেপ না নিয়েও তারা ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে পারবেন। তাই বয়স্ক বা অসুস্থ লোকদের অপ্রয়োজনীয় কারণে বাইরে না যাওয়া এবং তাদেরকে ঘরে থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে। করোনা নিয়ে সুইডিশরা বেশ আতঙ্কে আছে। কারণ অনেক দেশের কাছে পৃথিবীকে ধ্বংস করার মতো অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের বিপুল ভাণ্ডার রয়েছে। শত সহস্র কোটি ডলারের মজুদও আছে। কারো হাতেই করোনাভাইরাস মোকাবেলা করার কোন উপকরণ ও ওষুধ নেই। এই ভাইরাস গোটা বিশ্বের মানুষকে বেশ তছনছ করে দিচ্ছে। এর বিস্তার ক্ষমতা দেখে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ছোঁয়াচে রোগের কারণ আপনজনদের দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। করোনার সমাধান হয়তো একদিন হবে। তবে তত দিনে অনেকেরই জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। এই মহামারির মোকাবেলার একমাত্র সমাধান ঘরে থেকে এর বিস্তার রোধ করা। তবে শুধুমাত্র দুর্বল এবং বয়স্কদের জন্য এটা প্রযোজ্য। লকডাউন এবং আইসোলেশন করতে হবে শুধু দুর্বল এবং বয়স্কদের। বাকিদের সতর্ক এবং দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।
ইউরোপের মত বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না। তবে ইউরোপের বয়স্ক লোকের মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি হবার কারণে পুরো বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার ফলে পৃথিবীর সব কিছু অচল হবার পথে। গরীব দেশগুলো করোনায় মরবে না, তারা মরবে না খেয়ে। যেভাবে অর্থ দান করা হচ্ছে সারা পৃথিবীতে তাতে দেখা যাবে অর্থ থাকবে কিন্তু পণ্যের হবে অভাব। নতুন এক ভয়াবহ দুর্যোগ সময় আসবে যদি কোভিড-১৯ থেকে উদ্ধারের উপায় খুঁজে বের করতে না পারি। এখন আর কোনো সন্দেহের কারণ নেই যে করোনা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারপরও সমস্ত জানালা এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি আমাদের। করোনার ওষুধ তৈরি হবার আগ পর্যন্ত আমি মনে করি বয়স্কদের লকডাউন করা হোক, যাদের বয়স ৭০ প্লাস। বাকিদের কাজে যোগ দেওয়া শ্রেয় বলে আমি মনে করি। তবে সুইডেনের মত সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। বয়স্ক এবং দুর্বলদের থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। শেষে বলতে চাই, প্লীজ ডোন্ট ডাই বিফোর ইউর ডেথ। রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে rahman.mridha@gmail.com
সূত্র- যুগান্তর
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.