করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা: প্লাজমা থেরাপির সুযোগ সীমিত!
‘ভ্যাকসিন নেই, নেই নির্দিষ্ট কোনো ওষুধও। করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির সুযোগও সীমিত। প্লাজমা দেয়ার মতো সক্ষম ব্যক্তির সংখ্যাও বর্তমানে ৩৫-৪০ জনের বেশি নয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্ত থেকে প্লাজমা তৈরি করতে পারে এমন মেশিনের সংখ্যা দেড় ডজনের মতো হলেও সক্রিয় রয়েছে মাত্র ৬ থেকে ৭টি। এছাড়া করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপির বিষয়টি এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএসএ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) স্বীকৃত নয়- এমন বক্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
তাদের মতে, এ থেরাপির ওপর অনেকেই গুরুত্বারোপ করলেও এর প্রয়োগের সুযোগ খুবই কম। কাজেই রোগের লক্ষণ দেখে চিকিৎসার ওপরই করোনা আক্রান্তদের নির্ভর করতে হবে। এছাড়া ঘরে থেকে প্রতিরোধই করোনা বধের সহজ পথ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাজমা থেরাপি হল, করোনা আক্রান্তের পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা কোনো রোগীর শরীরে এই ভাইরাস প্রতিরোধে এক ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
সেই অ্যান্টিবডি যুক্ত প্লাজমা সংগ্রহ করে করোনা আক্রান্ত অন্য রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে ভাইরাসটিকে মেরে ফেলা হয়। তবে সব রোগীর অ্যান্টিবডি সমান নয়। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছে এমন সবাই প্লাজমা দিতে পারবে না। সাধারণত নারীদের শরীর থেকে নেয়া হয় না। তাছাড়া বৃদ্ধ এবং শিশুদের শরীর থেকেও নেয়া যৌক্তিক নয়। কারণ শিশু ও বৃদ্ধদের অ্যান্টিবডি দুর্বল থাকে। প্লাজমা নেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হল ২০ থেকে ৩৫ বছরের সুস্থ যুবক। কোনো মুমূর্ষু রোগীকে এটা দিতে হলে অবশ্যই কোনো করোনা আক্রান্ত সুস্থ ব্যক্তির রক্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশে যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের মধ্যে প্লাজমা দেয়ার মতো যোগ্য মানুষের সংখ্যা ৩৫ থেকে ৪০ জনের বেশি নয়। কাজেই এক্ষেত্রে সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের (নিপসম) পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়েজিদ খুরশিদ রিয়াজ যুগান্তরকে বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের বিষয়টি এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউএসএ সিডিসি কর্তৃক অনুমোদিত নয় দু-একটি দেশে এটি প্রয়োগ করা হলেও সেটির কোনো ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করা হয়নি।
তাই এ ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট-আইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৬২ জন। এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ১৫৫ জন। এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৩৯ জন।
আইডিসিআরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সীদের হার ৩ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের হার ৮ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের হার ২৬ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী আক্রান্তদের হার ২৪ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী আক্রান্তদের হার ১৮ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী আক্রান্তদের হার ১৩ শতাংশ এবং ষাটোর্ধ্ব ৮ শতাংশ। অর্থাৎ আইইডিসিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীদের ৫০ ভাগের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছর। যা মোট আক্রান্ত রোগীর অর্ধেক।
এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ পর্যন্ত সেরে ওঠা রোগীর শতকরা অর্ধেক এই বয়সী। যা প্রায় ৭০ জন। রোগ সেরে ওঠার পর সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন এবং রক্ত দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে এর অর্ধেক। অর্থাৎ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্লাজমা দেয়ার সক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা ৩৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের তথ্য মতে, একজন সুস্থ মানুষের রক্তে শতকরা ৫৫ শতাংশ প্লাজমা থাকে। আর ৪৫ শতাংশ থাকে রক্তের কোশ। রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করলে দেখা যাবে এর মধ্যে ৯২ ভাগ পানি ৭ দশমিক ৫ ভাগ প্রোটিন।
এই প্রোটিনের মধ্যে থাকে এলবোমিন এবং গ্লোবমিন। গ্লোবমিনের মধ্যে থাকে ইমিউনো গ্লোবমিন। যা শরীরে অ্যান্টিবিড তৈরি করে। যে কোনো সুস্থ মানুষের শরীরে কোনো ভাইরাস প্রবেশ করার তিন থেকে ৭ দিনের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। করোনা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেও এটি সত্য। তবে করোনা আক্রান্ত রোগী পরপর দু’বার নেগেটিভ প্রমাণিত হওয়ার পর কমপক্ষে ১৪ দিন অতিক্রান্ত না হলে তার শরীরে থেকে প্লাজমা নেয় যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১৫ থেকে ১৮টি অ্যাফরেসিস মেশিন আছে। এর মধ্যে রংপুর রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল কলেজে এই মেশিন রয়েছে। রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল এবং নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে এই মেশিন কার্যকর রয়েছে। এই মেশিনের সাহায্যে একজন মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিয়ে ২০০ এমএল প্লাজমা তৈরি করতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে একটি মেশিন দিয়ে দৈনিক ১০ থেকে ১২ জনের প্লাজমা সংগ্রহ সম্ভব।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শেখ দাউদ আদনান যুগান্তরকে বলেন, প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাতা নির্বাচন। কারণ নারী, বৃদ্ধ এবং শিশুদের শরীর থেকে প্লাজমা নেয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়। ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের শরীরের অ্যান্টিবডি শক্তিশালী থাকে। তাই এই বয়সী করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছে এমন লোকদের দাতা হিসেবে নিতে হবে।
তারপর ঠিক করতে যেসব মুমূর্ষু রোগীকে প্লাজমা দেয়া হবে তাদের। কারণ প্লাজমা তৈরি করার পরপরই সেটি রোগীর শরীরে দিতে হয়। তিনি বলেন, একজন সুস্থ-সক্ষম মানুষের শরীর থেকে প্রতি কেজিতে ১০ মিলি পরিমাণ প্লাজমা নেয়া যায়। বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী বলেন, একজন কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস রোগী সেরে উঠলেন। আক্রান্ত অবস্থায় ছিলেন কোভিড পজিটিভ, সুস্থ হওয়ার পর হলেন নেগেটিভ। তিনি নেগেটিভ হওয়াতে হয়ে উঠলেন অসুস্থ রোগীর জন্য প্লাজমা দাতা। তাকে মেডিকেল পরীক্ষা করলেন ডাক্তার, রক্ত পরীক্ষাও করা হল।
তাকে কাউন্সেলিং করা হল আর পদ্ধতিটি বোঝানো হল। দাতা এলেন হাসপাতালে যেখানে রক্তদান করবেন সেই বিভাগে, সেখানে তার ওপর যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে একে বলে এফারেসিস। রক্তদানের পর নেয়া হলে এফারেসিস মেশিনে, এরপর রক্ত সেন্ট্রি ফিউজ করা হল। প্লাজমা আলাদা করা হল আর বাকি লোহিতকণিকা, শ্বেতকণিকা আর অনুচক্রিকা ফিরিয়ে দেয়া হল দাতাকে। পদ্ধতিটি নিরাপদ আর করা হয় ওয়ানটাইম ইউজ সার্কিট দিয়ে।
মেশিন আর কিট সব আমদানিকৃত আর এতে আছে নিরাপদ ব্যবস্থা মেশিনের মধ্যে নির্মিত যাতে দাতা সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকেন। সংগৃহীত প্লাজমা নিয়ে যাওয়া হয় রোগীর কাছে আর তাকে প্লাজমা ভরন দেয়া হয়। এরপর রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। প্রসঙ্গত, করোনা চিকিৎসায় প্রথম অ্যান্টিবডি বা প্লাজমা থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা হয় চায়নায়। এরপর তুরস্ক, ইরান, ভারত ইত্যাদি দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো সম্প্রতি ভারতের কয়েকটি রাজ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’র ভিত্তিতে প্লাজমা থেরাপি শুরু হয়েছে। গত শুক্রবার দিল্লিতে পরীক্ষামূলকভাবে চারজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.