সুপার-ঘূর্ণিঝড়-আম্পান!

  • ব্রেকিং নিউস

    ইতালির পাশের দেশ স্লোভেনিয়া যেভাবে করোনা মোকাবেলায় সফল!

    111435_bangladesh_pratidin_Visit2

    করোনা ভাইরাস নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। কোনও ধরণের যুদ্ধ নয়, নয় কোনও ধরণের সামরিক অভিযান কিংবা কোনও ধরণের পারমাণবিক অভিযান অতি ক্ষুদ্র এক ধরণের আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবী অসহায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ২১২টি দেশে এ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে।

    প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো মানুষ এ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছেন, ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। চীনের উহান থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র নিষ্ঠুর থাবা বসিয়েছে এ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।  মধ্য ইউরোপে অবস্থিত ৭,৮২৭.৪ বর্গমাইলের ছোট দেশ স্লোভেনিয়া। সর্বশেষ ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে সব মিলিয়ে প্রায় ২১ লাখ লোকের বসবাস। সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা, বিভিন্ন ধরণের হৃদ ও স্কি রিসোর্টের জন্য দেশটি পর্যটকদের কাছে এক জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল হিসেবে পরিচিত।

    করোনার ছোবল থেকে নিষ্কৃতি পায়নি ইউরোপের ছোট ও সুন্দর স্লোভেনিয়া। তবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইতালি কিংবা ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন: স্পেন, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার বরাবরই কম।  এমনকি মৃত্যুর হার বিবেচনায়ও দেশটি ইউরোপের অন্য যে কোনো দেশ থেকে অনেকটা নিম্ন অবস্থানে। মহামারি করোনাভাইরাসে মোকাবেলায় দেশটি ইতোমধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের কাছে এক রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

    তবে "স্লোভেনিয়া" এ দেশটি আসলে তেমনভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত না হওয়ায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে স্লোভেনিয়া নিয়ে সে অর্থে তেমন আলোচনা হয় না বললেই চলে।  ওয়ার্ল্ড মিটারস কর্তৃক আজ ৪ মে পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন ১,৪৩৯ জন। পাশাপাশি গত চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে স্লোভেনিয়াতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আরও একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। এ নিয়ে দেশটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৯৭ এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ২৪৪ জন।

    গত দুই দিনে দেশটিতে নতুন করে আর কেউই এ করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হননি। এই ছোট পরিসংখ্যানই বলে দেয় করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কতটা সফল ইউরোপের ছোট এ দেশটি। আজ আমরা জানার চেষ্টা করবো ইতালির প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে স্লোভেনিয়া সফলভাবে এ করোনাভাইরাসের মোকাবেলা করলো? কেনই বা ইউরোপ এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে সে অর্থে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি ঘটেনি?  প্রথমত সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়া ডিসেন্ট্রালাইজড।

    পৃথিবীর অনেক দেশের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়, দেশটির অভ্যন্তরে বসবাস করা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা একটি নির্দিষ্ট শহর কেন্দ্রিক। হতে পারে সেটি দেশটির রাজধানী শহর, আবার হতে পারে সেটি দেশটির বৃহত্তম কোন একটি নগরী। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের প্রায় সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করে রাজধানী ঢাকায়। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা থেকে শুরু করে যাবতীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কার্যকলাপ সব কিছুই ঢাকাকে ঘিরে।  বাংলাদেশের সচেতন যে সকল নাগরিক রয়েছেন তারা সবাই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ঢাকাতে এসেই স্থায়ী হতে চায়। আবার দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল।

    আয়তনে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম এ দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ২৩ কোটির মতো। ব্রাসিলিয়া দেশটির রাজধানী হলেও দেশটির মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা সাও পাওলো এবং রিও ডি জেনিরোকে ঘিরে। তাই জনবসতির বিবেচনায় ব্রাজিলের এ দুইটি শহর দেশটির অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় অত্যধিক ঘনত্ববিশিষ্ট।  স্লোভেনিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি এ রকম নয়।

    স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা যা দেশটির বৃহত্তম নগরী। তবে স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জীবন শুধু এ লুবলিয়ানাকেন্দ্রিক নয়। স্লোভেনিয়ার প্রায় সর্বত্র জনবসতির বণ্টন রয়েছে এবং সমগ্র স্লোভেনিয়া সুউচ্চ আল্পস এবং ডিনারাইডস পর্বতমালা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকায় স্লোভেনিয়াতে এ জনবসতির বণ্টন অনেকটা ছড়ানো ছিটানো।

    স্লোভেনিয়ার প্রত্যেকটি মিউনিসিপালিটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কারও আসলে এক মিউনিসিপালিটি (শহর) থেকে অন্য মিউনিসিপালিটিতে যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন হয় না।  এমনকি স্লোভেনিয়াতে আমার বসবাস যে এলাকায় সেটি আক্ষরিক অর্থে একটি নিভৃত পল্লী অথচ ছোট এ এলাকাতেই আমার জীবনের সকল প্রয়োজনীয় চাহিদা ভালোভাবে পূরণ করা সম্ভব।

    করোনাভাইরাসের মহামারি বিস্তার প্রতিরোধে স্লোভেনিয়ার সরকার গত ১৯ মার্চ থেকে সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াকে জরুরি অবস্থায় নিয়ে আসে যার প্রেক্ষিতে বিশেষ অনুমতি ব্যতিরেকে এক মিউনিসিপালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপালিটিতে যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়। ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যবস্থার কারণে মানুষের খুব বেশি দেশটির অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বিশেষ করে লুবলিয়ানা, মারিবোর, ছেলইয়ে, ক্রানিয়ের মতো বড় শহরগুলোতে যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন পড়েনি।

      স্লোভেনিয়া উত্তর দিক থেকে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে -হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া, পশ্চিমে ইতালি এবং দক্ষিণে ভূ-মধ্যসাগরের শাখা অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে ছিল ইতালি আর স্পেন এবং এ হিসেবে ইতালির সীমান্তবর্তী স্লোভেনীয় অংশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় থাকার কথা ছিল। অথচ স্লোভেনিয়ার এ অংশে অর্থাৎ পশ্চিম স্লোভেনিয়াতে দেখা যায় যে দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। 


    সমগ্র স্লোভেনিয়াতে যখন করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা এক হাজার ছুঁই ছুঁই তখনও স্লোভেনিয়ার এ অংশে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশেরও কম। ইতালিতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করার সঙ্গে স্লোভেনিয়া সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলেস শাবেদার সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াতে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেন। ঐতিহাসিকভাবে ইতালি এবং স্লোভেনিয়া বিভিন্নভাবে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা হলেও প্রকৃতপক্ষে ইতালির ত্রিয়েস্তে ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বড় শহর ছিল যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্লোভেনিয়ান জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিল। 

    এছাড়াও স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলবর্তী এলাকা যেমন: কপার, ইজোলা, পোর্তোরস কিংবা ক্রোয়েশিয়ার পুলা অথবা পরেচ এ সকল জায়গায় প্রচুর ইতালিয়ানদের বসবাস রয়েছে। এমনকি এ সকল জায়গায় যারা স্থায়ী হন তাদেরকে স্লোভেনিয়ান অথবা ক্রোয়েশিয়ান এবং ইতালিয়ান দুইটি ভাষায় দক্ষ হতে হয় এবং এ সকল জায়গার শিক্ষা-প্ৰতিষ্ঠানগুলো উভয় ভাষায় পাঠদান করে থাকে।

    এছাড়াও সাগরের তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এ অঞ্চলগুলোতে সব সময় জনসমাগম থাকে কিন্তু ইতালিতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে না করতে স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম এ অঞ্চলগুলোতে মানুষের অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়।  এমনকি সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে মানুষের জমায়েতকে কমিয়ে আনার জন্য স্পেশাল পুলিশ ফোর্স মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব প্রিমোরস্কাসহ এ সকল জায়গার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাময়িকভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়। গত ৪ মার্চ স্লোভেনিয়াতে সর্বপ্রথম করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি মরক্কো থেকে ইতালি হয়ে স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করেছিলেন।

    স্কি স্লোভেনিয়ার একটি জনপ্রিয় খেলা এবং স্লোভেনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ স্কির প্রতি আসক্ত। স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে বলা হয়, স্লোভেনিয়াতে সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে যাদের শরীরে কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে তাদের একটি বড় অংশ পজিটিভ ধরা পড়ার কয়েক দিন আগে ইতালিতে গিয়েছিল স্কি খেলার জন্য।  যেহেতু স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঘটে ইতালির মাধ্যমে এবং একই সঙ্গে ইতালিতে যখন করোনার ছোবল সবচেয়ে তীব্র পর্যায়ে ঠিক তখনই স্লোভেনিয়ার সরকার ইতালির সঙ্গে স্লোভেনিয়ার সীমান্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

    ইতালি থেকে যারা স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করেন সবাইকে মেডিকেল চেক আপের আওতায় আনা এবং তাদেরকে আইসোলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়াসহ অন্যান্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। মার্চের ১৯ তারিখ থেকে স্লোভেনিয়াতে বাস, ট্রেনসহ সকল ধরণের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং একইসঙ্গে রাজধানী লুবলিয়ানাতে অবস্থিত দেশটির একমাত্র বিমানবন্দর ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকেও সকল ফ্লাইট স্থগিত করে দেওয়া হয় যা আজও কার্যকর রয়েছে। 

    এমনকি বিভিন্ন ধরণের কার রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। ট্যাক্সিচালকদের বলা হয়েছে প্রত্যেকবার যাত্রী বহনের শেষে তাদের ট্যাক্সিগুলোকে নিয়মিতভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে যাতে করোনাভাইরাসের বিস্তার অনেকটা রোধ করা যায়। স্লোভেনিয়াতে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়াকে জরুরি অবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তখনও স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি জটিল পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

    ছোট বাচ্চাদের করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবল থাকায় সবার প্রথমে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পর্যায়ক্রমে ইউনিভার্সিটিসহ সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ঘোষণা করা হয়।  সকল ধরণের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয় এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবাইকে মোবাইলে ম্যাসেজের মাধ্যমে জানানো হয় যে কোন পাবলিক প্লেসে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সবাইকে মুখে মাস্ক ও হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পরিধান করতে হবে। পারাস্পরিক ১.৫ এর দূরত্ব বজায় রাখতে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কেউ যদি তাদের এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করে তাহলে তাকে ন্যূনতম ৪০০ ইউরো জরিমানা করার কথা বলা হয় স্লোভেনিয়ার পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

    লুবলিয়ানা, মারিবোর, ক্রানিয়ে, ছেলইয়ের মতো বড় শহরগুলোতে পুলিশ প্রশাসনকে যতটা সম্ভব কড়া অবস্থানে থাকতে দেখা গিয়েছে যাতে এ সকল শহরে বসবাসরত জনসাধারণ এ নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলতে পারে। স্লোভেনিয়ার সরকার তো বটেই এমনকি দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যাংক, পোস্ট অফিস, সুপার শপ, খাবারের দোকান, পেট্রোল স্টেশন, হাসপাতাল, ফার্মেসি অর্থাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় সেবামূলক যে সকল প্রতিষ্ঠান এ অবস্থার মধ্যেও কাজ করে গিয়েছে সকল প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে একজন কিংবা একই পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

    প্রথম দিকে অবশ্য মুখে মাস্ক এবং হাতে হ্যান্ড গ্লাভস পরিধান না করা থাকলে কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো না। কয়েক দিন পূর্বে হ্যান্ড গ্লাভসের বাধ্যবাধকতা শিথিল করে নেওয়া হলেও প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়েছে এবং এখন থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে এ সকল প্রতিষ্ঠানের ভেতর প্রবেশ করতে হলে সবার প্রথমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও যে সকল ফ্যাক্টরি তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করেছে, তাদেরকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে স্লোভেনিয়া সরকারের প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

    প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরিতে থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থা ছিল যাতে নিয়মিত ফ্যাক্টরির অধীনে কাজ করা সবাইকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা যায়। এছাড়াও স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে স্পেশাল হটলাইন চালু করা হয়। কেউ শরীরে ব্যথা, সর্দি, কাশি, জ্বরসহ কোভিড-১৯ এর সঙ্গে সম্পর্কিত কোন উপসর্গের সম্মুখীন হলে তাকে তৎক্ষণাৎ ১১২, ০৮০১৪০৪ এবং +৩৮৬৩১৬৪৬৬১৭ এ তিনটি নাম্বারের যে কোনও একটিতে ফোন দিতে বলা হয়। 

    প্রত্যেক মিউনিসিপালিটি এলাকায় ১১২ এ বিশেষ নাম্বারের লোগো সম্বলিত বিশেষ গাড়ি টহলে নিয়োজিত ছিল যা এখনও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কেউ যদি মনে করেন যে তার শরীরে কোভিড-১৯ এর কোন লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে তৎক্ষণাৎ স্থানান্তর করার জন্য সব সময় ১১২ এ বিশেষ নাম্বারের লোগো সম্বলিত বিশেষ গাড়িটি কাজ করছে। আগের থেকে সতর্কতা গ্রহণ করায় স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। ৪ মে পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন ১৪৩৯ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন ৯৭ জন।

    যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ৬৭ এর ওপর এবং তাদের অনেকের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অ্যাজমাসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা ছিল বলে স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে।  এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ২৪.১ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ এর মধ্যে। এছাড়াও স্লোভেনিয়ার সরকারের ঘোষিত আর্থিক বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশটির সাধারণ মানুষের মাঝে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। কৃষক এবং স্লোভেনিয়াতে যারা পেনশনভোগী তাদের জন্য এ সময় স্লোভেনিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।

    শিক্ষার্থীদেরকে মাসে ১৫০ ইউরো করে অনুদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং এ পরিস্থিতির কারণে সাময়িকভাবে যাদের কাজ নেই তাদেরকে বেতনের ৮০% করে দিতে বলা হয়েছে স্লোভেনিয়া সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তবে একটি বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গিয়েছে আর সেটি হচ্ছে স্লোভেনিয়াতে যে সকল বিদেশি নাগরিক রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া সরকারের ঘোষিত সুস্পষ্ট কোন নীতিমালা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।  করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্টেম সেল থেরাপি কিংবা প্ল্যাজম থেরাপির কথা বলা হচ্ছে। স্টেম সেল নামক এক বিশেষ ধরণের কোষ রয়েছে যারা আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে, স্টেম সেলকে মেমোরি সেল হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়।

    আমরা যখন কোনো রোগ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠি পরবর্তীতে যখন ওই একই ধরণের রোগ জীবাণু আমাদের শরীরে আক্রমণের চেষ্টা করে স্টেম সেল সেগুলোকে পূর্বের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শনাক্ত করার চেষ্টা করে এবং এ সকল রোগ জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে।  বর্তমানে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় আলোচিত এ স্টেম সেল থেরাপি যেখানে বলা হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে সুস্থ হয়েছেন এমন কোন ব্যক্তির প্লাজমা বা রক্তরস আক্রান্ত অন্য কোন ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে সে ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

    করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি নিয়ে যে সকল ইন্সটিটিউট গবেষণা করেছে তার মধ্যে স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথের ডিপার্টমেন্ট অব ইমিউনলজি এবং ডিপার্টমেন্ট অব ভাইরোলজির অন্যতম যাদের সমন্বিত গবেষণালব্ধ ফলাফল যা পৃথিবীর অনেক দেশই অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। এছাড়াও স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকরী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তুত করা ভ্যাকসিনের নমুনা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দেশটিতে এখন অনেকটা উন্নতির দিকে, কেননা গত দুই দিন নতুন করে কেউই এ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হননি। 

    প্রতিবেশী রাষ্ট্র অস্ট্রিয়ার মতো ধীরে ধীরে স্লোভেনিয়াতেও মার্চ মাসের ১৯ তারিখ থেকে জারি করা জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে এতদিন বিশেষ অনুমতি ব্যতিরেকে স্লোভেনিয়ার অভ্যন্তরে এক মিউনিসিপালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপালিটিতে যাতায়াতের ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার থেকে সে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে। পাশাপাশি আজ সোমবার (৪ মে) থেকে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে কফিশপ, বার এবং রেস্টুরেন্টগুলোকে খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও গত ২৯ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, থিয়েটার, লাইব্রেরিগুলোকেও পুনরায় চালু করে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

    No comments

    If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.

    পৃষ্ঠা

    সর্বশেষ খবর

    COVID-19 থেকে বাঁচার উপায় !