প্রণব মুখার্জিঃ সাবেক রাষ্ট্রপতি দুই বাংলায় ‘প্রিয়জন’!
প্রণবের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরের মিরিটি গ্রামে। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কংগ্রেস নেতা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি, এআইসিসি সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদেরও সদস্য হয়েছিলেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে রাজনীতি প্রণবের উত্তরাধিকারসূত্রেই পাওয়া। যদিও সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতির ছায়া মাড়াননি তিনি।
বরং ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্বের পর মন দিয়েছিলেন আইনের ডিগ্রি পাওয়ায়। তবে আইনজীবীর পেশাকে বাছেননি কখনই। ডাক ও তার বিভাগে করণিক এবং হাওড়ার বাঁকড়া স্কুলে শিক্ষকতা পর্বের পর ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় যোগ দেন।
১৯৫৭ সালে নড়াইলের মেয়ে শুভ্রা দেবীকে বিয়ে করেন। বিদ্যানগর কলেজে যোগ দেয়ার পর টানা পাঁচ বছর আমতলাতেই ছিলেন প্রণব। রিকশা করে যাতায়াত করতেন প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরের কলেজে। মুখার্জি দম্পতির বেশ পছন্দও হয়ে গিয়েছিল জায়গাটি। সেখানে থিতু হওয়ার জন্য জমিও কিনে ফেলেছিলেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।
১৯৬৬ সালে বিদ্যানগর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ মজুমদারের হাত ধরে, শুরু হওয়া রাজনৈতিক সফর প্রণবকে টেনে নিয়ে যায় অনেক দূরের অন্য ঠিকানায়। কংগ্রেসি রাজনীতিতে বরাবর যা গুরুত্ব পেয়ে এসেছে, সেই পারিবারিক গরিমা কিন্তু প্রণব মুখার্জিয়ের তেমন ছিল না। যদিও তার বাবা স্বাধীনতাসংগ্রামী ছিলেন।
কিন্তু দেশের নানা প্রান্ত থেকে উঠে আসা অন্য অনেক কংগ্রেসি মহারথীদের ক্ষেত্রে যে পারিবারিক আভিজাত্যই ছিল সবচেয়ে বড় সম্বল, প্রণব মুখার্জির ক্ষেত্রে তা ছিল না। সাফল্যের পেছনে ছিল তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, মেধা এবং তার পরিশ্রম করার ক্ষমতা। যখন যে দায়িত্বই পেয়েছেন, সেটাকেই সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। তিনি রাষ্ট্রপতি পদে যাওয়ার আগে শেষ তিন বছর, অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত লোকসভার নেতা ছিলেন। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও প্রণব মুখার্জিকে সম্মান করতেন, নানা বিষয়ে তার উপদেশ নিতেন।
এত কিছুর পরও শিকড়কে ভোলেননি কখনও। দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে এত বছর বিচরণ করেও খাঁটি বাঙালিই থেকে গিয়েছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত। সেই ধুতি-পাঞ্জাবিই ছিল প্রিয় পোশাক। পুজোর সময়ে বীরভূমে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে পারিবারিক দুর্গোৎসবে তন্ত্রধারক হওয়াই ছিল তার জীবনের নিয়ম। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেয়ার পর সে অর্থে আর সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন না। কিন্তু তবু যেন থেকে গিয়েছিলেন রাজনীতির অভিভাবক হয়ে।
তাই প্রণব মুখার্জির চলে যাওয়া ভারতীয় রাজনীতিতে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করল। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর যে দুঃসময়, সে সময়টাতেও ইন্দিরাজির প্রতি আনুগত্যে অবিচল থাকার পুরস্কারটাই ১৯৮০ সালে পেয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরেই প্রণবকে ইন্দিরা ক্যাবিনেট মন্ত্রী করেছিলেন। একাধারে দেশের অর্থমন্ত্রী এবং রাজ্যসভার নেতা।
১৯৮৪ সালে ইন্দিরাজি নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত মন্ত্রিসভায় সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড তিনিই। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে প্রণব মুখার্জির ঘোর দুর্দিন শুরু হয় কংগ্রেসে। রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথমদিকে তিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। আলাদা দল গড়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। পরে ১৯৮৯ সালে তিনি কংগ্রেসে ফিরে আসেন।
রাজীবের মৃত্যুর পরে দলে ও সরকারে নরসিংহ রাওয়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় এবং সেই নরসিংহ-যুগ শুরু হতেই প্রণব মুখার্জির পুনরুত্থান শুরু হয়ে যায়। প্রথমে তিনি যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদ পান। তার পরে বাণিজ্যমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার বাইরে ছিল কংগ্রেস। ফলে প্রণব মুখার্জিও ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু কংগ্রেসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই ছিলেন। ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ।
মনমোহন সিংহের সেই মন্ত্রিসভায়ও প্রণববাবু নাম্বার-টু হয়ে উঠেন। প্রথমে তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পরে হন অর্থমন্ত্রী। তবে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের মাপজোখে একটানা দুই নম্বরে। ২০১২ সালে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে চলে গিয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার আগে পর্যন্তই তিনি থেকে গিয়েছিলেন ওই অবস্থানে।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.