নির্বাচনের ফল তুরস্কের সম্পর্কে কী প্রভাব ফেলবে?
তুরস্কের সরকার আমেরিকার নির্বাচনে সরাসরি কোনো প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তার ঘোরতম প্রতিদ্বন্ধি জো বাইডেনের মধ্য থেকে যদি একজনকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে তুর্কিরা ট্রাম্পকেই আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চাইবে। এর কারণ খুঁজতে চাইলে প্রথমে তুরস্ক এবং যুক্তরাস্টের বিগত কয়েক বছরের সম্পর্কে একটু চোখ বুলাতে হবে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকেই দু দেশের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। বিশেষ করে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন অজুহাতে তুরস্ককে সিরিয়াতে সংকটে ফেলার জন্য ওবামা সরকারকে দায়ী করে আঙ্কারা। যেমন সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সেদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যমপন্থী বিরোধী গ্রুপগুলোকে ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগিতার জন্য ওয়াশিংটন এবং আঙ্কারা একত্রে কাজ করার কথা বলে ট্রেনিং শুরুর কিছুদিন পরে আমেরিকা পিছু হটে।
পরবর্তীতে দক্ষিণ পূর্ব তুরস্কে সক্রিয় পিকেকে নামক সন্ত্রাসী সংগঠনটির সিরীয় শাখার সাথে হাত মিলে আমেরিকা। তুরস্কের শত আপত্তি সত্ত্বেও ওই সন্ত্রাসী গ্রুপটিকে বিপুল পরিমানে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে। পরবর্তীতে সে অস্ত্র তুরস্কের ভিতরে নিয়ে এসে তুর্কি নিরাপত্তা বাহিনীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার পিকেকে নামক এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি।
পিকেকে-র সিরীয় অংশকে বিপুল অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার যে বুদ্ধি তার প্রধান কারিগর ছিলেন জো বাইডেন। বাইডেনের বুদ্ধিতেই তখন ওবামা প্রশাসন ন্যাটো জোটের সদস্য হওয়ার পরেও তুরস্কের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং তুরস্কের সীমান্তজুড়ে গড়ে উঠা এই সন্ত্রাসী গ্রুপটিকে অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে শক্তিশালী করতে মরিয়া হয়ে উঠে। ফলে তুরস্কের ভিতরেও তারা যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্রের মজুত করে ২০১৫-২০১৬ সালে তুর্কি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক লড়াইয়ে নামে এই গ্ৰুপটি।
পরবর্তীতে তুরস্ক দেশের ভিতরে তাদেরকে দমন করে যখন সিরিয়াতেও এই সন্ত্রাসী গ্রুপটির বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন আমেরিকার সৈন্যরা তাদেরকে ঢাল হয়ে রক্ষা করে। সেই যে শুরু, তারপরে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তুরস্কের কাছে আমেরিকার এয়ার ডিফেন্স মিসাইল বিক্রি না করে আঙ্কারা বাধ্য হয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনে নিলে আমেরিকার সিনেট তুরস্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক এবং সামরিক অবরোধ জারি করার সুপারিশ করে।
কিন্তু ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্সি ক্ষমতাবলে তুরস্কের বিরুদ্ধে অবরোধকে ঠেকিয়ে রাখেন। এর পিছনেও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজ করছে। যদিও ট্রাম্প আবার নির্বাচিত হলেও এই অবরোধকে কতদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারেন তা নিশ্চিত না। তবে বাইডেন নির্বাচিত হলে তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক যে সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করবেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তুরস্কে অবরোধ আরোপ করা। এছাড়াও ট্রাম্পের সাথে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ইতিবাচক সম্পর্কের কারণে তুরস্ক রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে তিনি বেশ মাথা ঘামাননি। কিন্তু বাইডেন তা করবেন না।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার সৈন্যদের ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তে আঙ্কারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু বাইডেন নির্বাচিত হলে হয়তো নতুন করে আবার সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সাম্প্রতিককালে সিরিয়া, লিবিয়া, ভূমধ্যসাগর এবং নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চলগুলোতে তুরস্কের শক্তিশালী উপস্থিতি ট্রাম্পকে ভাবিয়ে না তুললেও বাইডেন অনেক স্পষ্ট করেই তুরস্কের উপস্থিতির বিরোধিতা করেছেন এবং নির্বাচিত হলে তুরস্ককে এক হাত দেখিয়ে দেয়ারও হুমকি দিয়েছেন। এবছরের জানুয়ারিতে এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বাইডেন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে তুরস্কে সরকার পরিবর্তনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
এমনকি তুরস্কের অনেক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল যে বাইডেন ২০১৬ সালের রক্তাক্ত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগে তুরস্কে ছিলেন এবং অভ্যুত্থানকারীদের সমর্থন দিয়েছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থানের প্রধান হোতা এবং আমেরিকায় বসবাসকারী ফেতুল্লা গুলেন এবং তার সমর্থকদের বাইডেন এবং তার পার্টির সাথে যোগসাজশ কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। এসব কিছুর বিচারে আমেরিকার নির্বাচনে বাইডেনের বিজয় এরদোগানের জন্য কোনো শুভ সংবাদ বয়ে আনবে না।
বাইডেনের নির্বাচন মধ্যপ্রাচ্যেও কিছু কিছু দেশের সরকারকে বিচলতি করবে বৈ কি। বিশেষ করে সৌদি আরবের জন্য তিনি মাথা ব্যাথার কারণ হবেন। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার বিষয়ে ট্রাম্প সরাসরি হস্তক্ষেপ করে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্ত বাইডেন এই বিচারকে চালিয়ে নিবেন এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবেন বলে ধারণা করা হয়।
যদি তিনি তাই করেন তবে তা হবে তুরস্ককে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার সমতুল। এছাড়া বাইডেন সৌদির চিরশত্রু ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের মতো কঠিন কোনো পদক্ষেপ নেবেন না বলে মনে করা হয়। সুতরাং ধারণা করা হয়, ট্রাম্পের একক পক্ষপাতিত্বের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের যে সব দেশ বিশেষ সুযোগ সুবিধা পেত বাইডেনের নির্বাচনে তারা যথেষ্ট অসুবিধায় পড়বেন। আমেরিকার ভোটাররা হয়তো তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই ভোট দিবেন।কিন্তু আমেরিকার এ নির্বাচন তুরস্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের ভাগ্য নির্ধারনের নির্বাচন হিসেবে পরিগণিত হবে।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.