চাণক্যের ভালো থাকার ৪ সূত্র
চাণক্যের ভালো থাকার ৪ সূত্রঃ
সার্বিক প্রয়োজনে অনেক বিষয় নিয়েই লিখেছেন চাণক্য। কিন্তু মানুষ মাত্রই ভালো থাকতে চায়। ভালো থাকার জন্য চাণক্য কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন।
১) টাকা-পয়সার নিদারুণ সংকট থাকলে কাউকে কখনো বলতে নেই। কারণ এ সময় কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না, আবার কপট সাহায্যের আশ্বাস দেয়। কারণ তার মতে দরিদ্ররা সমাজে তেমন মর্যাদা পায় না। তাই তাদের নিজের সম্পদ নিজের কাছেই রাখা উচিত।
২) মহামতি চাণক্যর মতে ব্যক্তিগত সমস্যা কখনো কাউকে বলতে নেই। যারা বলে তারা অন্যের কাছে নীচু ও বিরক্তিকর হিসেবে গৃহীত হয়, আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে নেই। এসব বললে মানুষ মনে করে কিছু একটা অভিপ্রায় নিয়ে তা বলা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে ভয়ঙ্কর ফল নিয়ে আসতে পারে। জ্ঞানী ব্যক্তির মতো মৃত্যু পর্যন্ত তা নিজের কাছে রেখে দেওয়া উচিত।
৩) যদি কখনো নীচপদস্থ ব্যক্তি দ্বারা অপমানের স্বীকার হওয়া যায়, তাহলে তা অন্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করাটাই ভালো। তাহলে মানুষ বক্তার সামনেই তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে পারে। ফলে তা মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানতে পারে।
৪) আদর দেওয়ার অনেক দোষ, শাসন করার অনেক গুণ। তাই পুত্র ও শিষ্যকে শাসন করাই দরকার, আদর দেওয়া নয়। পাঁচ বছর বয়স অবধি পুত্রদের লালন করবে, ১০ বছর অবধি তাদের চালনা করবে, ১৬ বছরে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করবে। পুত্রকে যারা পড়ান না, সেই পিতা-মাতা তার শত্রু। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সব তারা মিলেও তা পারে না। তেমনি একটি গুণী পুত্র একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে ভালো।
নীতির দর্পণ সারাংশঃ
চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী হওয়ার পর প্রাসাদের জীবন ছেড়ে কুঁড়েঘরের সন্ন্যাসী জীবন বেছে নিয়েছিলেন চাণক্য। সেখানে শিষ্যদের নানা বিষয়ে নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। এসব বিষয়ের কিছু কিছু তার অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহীত হয়েছে। এ ধরনের একটি সংকলন- ‘চাণক্য নীতি দর্পণ’। চলুন দেখে নেওয়া যাক চাণক্যের নীতির দর্পণ সারাংশ।
১) যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন না এবং শুধু অভিযোগ করেন যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।
২) সব উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সে জন্য সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তছরুপ বা অর্থ আত্মসাতের ৪০টি পদ্ধতি আছে। জিহবার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোনো রাজকর্মচারীর পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব ব্যাপার। জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করেও বোঝা সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজকর্মচারীর তহবিল তছরুপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব, কিন্তু রাজকর্মচারীর গোপন কার্যকলাপ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।
৩) বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নীচ কারও থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে শুভলক্ষণা স্ত্রী এসব গ্রহণ করা সংগত।
৪) মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।
৫) যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্য কোনো কিছুই জয় করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোনো ব্যক্তির জন্য কোনো দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোনো শত্রু নেই।
৬) বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। অনুরূপ যে কাজ করে অর্থ সব সময় তাকেই অনুসরণ করে।
৭) মন খাঁটি না হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।
তিনি ছিলেন কঠোর।
চাণক্য শ্লোকঃ
বাস্তববাদী চাণক্যের অর্থনীতি, রাজনীতি, জীবনযাপন ইত্যাদি নিয়ে বলা কথাগুলো ‘চাণক্য শ্লোক’ নামে পরিচিত। সূদীর্ঘ আড়াই বছর পরেও কথাগুলোর গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি। কথিত হয় যে, এখনো ভারতের রাজনীতি অনেকাংশে চাণক্যনীতি অনুযায়ী চলমান। চাণক্যের নীতি পৃথিবীর বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। প্রশংসিত হয়েছে বহু দেশে। হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও তার নীতি এখনো সমানভাবে কার্যকর। সেখান থেকেই কয়েকটি শ্লোক দেখে নেওয়া যাক।
♦ দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।
♦ দুষ্ট স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সসর্প-গৃহে বাস মৃত্যুর দ্বার, এ বিষয়ে সংশয় নেই।
♦ পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।
♦ আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্ন প্রকৃতি-কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।
♦ অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না।
♦ অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।
♦ অনেকে চারটি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও আত্মাকে জানে না, হাতা যেমন রন্ধন-রস জানে না।
♦ অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।
♦ আপদের নিশ্চিত পথ হলো ইন্দ্রিয়গুলোর অসংযম, তাদের জয় করা হলো সম্পদের পথ, যার যেটি ঈঙ্গিত সে সে পথেই যায়।
♦ আড়ালে কাজের বিঘ্ন ঘটায়, কিন্তু সামনে ভালো কথা, যার উপরে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।
♦ গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।
♦ অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাঞ্চায় সম্মান নাশ হয়, দারিদ্র্য বুদ্ধিনাশ হয়।
♦ অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্নে ভোজন, দরিদ্রের সভায় বা মজলিশে কালক্ষেপণ এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।
♦ ধর্মের চেয়ে ব্যবহারই বড়।
♦ বিনয়ই সবার ভূষণ।
♦ বষ থেকেও অমৃত আহরণ করা চলে, মলাদি থেকেও স্বর্ণ আহরণ করা যায়, নীচজাতি থেকেও বিদ্যা আহরণ করা যায়, নীচকুল থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা যায়।
♦ ভাগবাসনায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়।
♦ মিত ভোজনেই স্বাস্থ্যলাভ হয়।
♦ ইন্দ্রিয়ের যে অধীন তার চতুরঙ্গ সেনা থাকলেও সে বিনষ্ট হয়।
♦ উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য।
♦ ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।
♦ একটি মাত্র পুষ্পিত সুগন্ধ বৃক্ষে যেমন সমস্ত বন সুবাসিত হয়, তেমনি একটি সুপুত্রের দ্বারা সমস্ত কুলধন্য হয়।
♦ একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একটি গুণীপুত্র বরং ভালো। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সব তারা মিলেও তা পারে না।
♦ একটি দোষ বহু গুণকেও গ্রাস করে।
♦ একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বন ভস্মীভূত হয়, তেমনি একটি কুপুত্রের দ্বারাও বংশ দগ্ধ হয়।
♦ উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।
♦ কর্কশ কথা অগ্নিদাহের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
♦ খেয়ে যার হজম হয়, ব্যাধি তার দূরে রয়।
♦ গুণবানকে আশ্রয় দিলে নির্গুণও গুণী হয়।
♦ গুণহীন মানুষ যদি উচ্চ বংশেও জন্মায় তাতে কিছু আসে যায় না। নীচকুলে জন্মেও যদি কেউ শাস্ত্রজ্ঞ হয়, তবে দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন।
♦ অহংকারের মতো শত্রু নেই।
♦ তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয় : নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, জপ, আর দান এই তিন বিষয়ে যেন কোনো সন্তোষ না থাকে।
♦ দারিদ্র্য, রোগ, দুঃখ, বন্ধন এবং বিপদ-সব কিছুই মানুষের নিজেরই অপরাধরূপ বৃক্ষের ফল।
♦ দুর্জনের সংসর্গ ত্যাগ করে সজ্জনের সঙ্গ করবে। অহোরাত্র পুণ্য করবে, সর্বদা নশ্বরতার কথা মনে রাখবে।
চাণক্যের ভালো থাকার ৪ সূত্র, চাণক্যের সূত্র, নীতির দর্পণ সারাংশ, চাণক্য শ্লোক
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.