সাড়ে ৯ হাজার জরাজীর্ণ ভবনে চলছে পাঠদান
সারা দেশে ঝুঁকিপূর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯ হাজার ৬৬১টি। এগুলোর অধিকাংশই ২০০০ সালের পর নির্মাণ করা। বাকি ভবনের বয়স ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। নিুমানের উপকরণ দিয়ে ভবন নির্মাণ করায় প্রাথমিকের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী শ্রেণীকক্ষেই মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে।ভবনগুলোর কোনোটির পিলার নড়বড়ে, কোনোটির ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে। ভবনগুলোর ছাদের অবস্থা খুবই নাজুক। পলেস্তারা উঠে বেরিয়ে পড়েছে ছাদ ও বিমের রড-কাঠ। ভবন নতুন হলেও অনেক ভবনের দরজা-জানালাও নেই। আসবাবপত্রেরও করুণ দশা। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো ভবন সংস্কারের সুযোগ না থাকলে তা পরিত্যক্ত এবং বাকিগুলো সংস্কারে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কথা হয় ইতিপূর্বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি, সাবেক ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ) একজন সিনিয়র প্রকৌশলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, যদি একটি ভবন নির্মাণে বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় হয়, তাহলে কিছুতেই তা ৫০ বছরের আগে সংস্কারের দরকার পড়ে না। ভবন ভেঙে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে রড ছাড়া কাঠ- বাঁশের ব্যবহার এবং যথাযথ পরিমাণ বালু ও সিমেন্ট না থাকলে।
ঠিকাদার তো লাভ করতেই চাইবে। কিন্তু স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী নির্মাণকাজ নিশ্চিত করা প্রকৌশলীর দায়িত্ব। তিনি বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে গ্রামের স্কুলগুলো এলজিইডি নির্মাণ করছে। শহরেরগুলো ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ ২০০০ সাল পর্যন্ত নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে। দেখা যাবে, ঢাকা শহরে ’৮০-এর দশকে নির্মিত স্কুল এখন পর্যন্ত সংস্কারও করতে হয়নি।এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে নির্মিত করাতিটোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পরবর্তীতে তৈরি মানিকদীতে অবস্থিত ব্রাহ্মণনগর এবং বাংলামোটরের খোদেজা খাতুন স্কুল অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু চুনকাম করলেই নতুনের মতো দেখায়। তিনি বলেন, তাদের নির্মাণ ব্যয় বেশি বলে এলজিইডিকে কাজ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু আসলেই কি কম টাকায় ভবন হচ্ছে?
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) এবং মাঠপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এলজিইডির ভবন নির্মাণের সময় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। নির্মাণ শেষে স্কুলের পরিচালনা কমিটি এবং প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরে ভবনটি হস্তান্তর করা হয়। গোটা কাজ তদারকি করেন উপজেলা প্রকৌশলী।
সার্বিক দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট ইউএনও। তবে হস্তান্তরের পর এসব ভবন রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা ও তদারকির ভার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) জেলার গোটা শিক্ষার ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এরপরও প্রাথমিকের ভবনগুলোর মরণ ফাঁদে পরিণত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ৬ এপ্রিল বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী পিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদের ভিম ভেঙে পড়লে একজন শিশু ছাত্রী নিহত এবং ৯ জন আহত হয়।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, মাঠপ্রশাসনের মাধ্যমে সারা দেশের স্কুল ও এর শিক্ষার সার্বিক দিক তদারকি করানো হয়। তা সত্ত্বেও বরগুনার একটি স্কুলে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আমরা খুবই ব্যথিত। এ ঘটনায় ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে, তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউই রেহাই পাবে না। তদন্ত কমিটি রোববার নাগাদ প্রতিবেদন দেবে। তার ভিত্তিতে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা সংগ্রহের কাজ চলছে। দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা চূড়ান্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক্ষেত্রে কোনো ভবন সংস্কারের সুযোগ না থাকলে তা পরিত্যক্ত করা হবে। বাকিগুলো সংস্কারে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে।ডিপিই সূত্র জানায়, জরাজীর্ণ ও ভবন না থাকা স্কুলের সংখ্যা চিহ্নিত করা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত কাজের অংশ। এ লক্ষ্যে ‘প্রাথমিক শিক্ষা সম্পদ ব্যবস্থাপনা তথ্য ব্যবস্থা’ (পিইপিএমআইএস) নামে একটি সফটওয়্যারও আছে। তাতে সারা দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে সেই আলোকে সংস্কার বা নতুন ভবন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৯ হাজার ৬৬১টি স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ।
বরিশাল অঞ্চলের থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানা ধরনের ভবন আছে। এর মধ্যে সেমিপাকা টিনশেডগুলো ৩৫-৪০ বছর আগের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সাবেক ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ ভবনগুলো নির্মাণ করে। সেগুলো এখনও শক্ত মজবুত। কিন্তু পরে কম পয়সায় এলজিইডি যেসব ভবন তৈরি করেছে সেগুলোর অবস্থাই বেশি নাজুক। গত ২০ বছরে তৈরি ভবনগুলো মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, বরগুনার তালতলীতে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুল ভবনটি ২০০২ সালে এলজিইডির করা। ২০০৪ সালে সেটি হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের মনিটরিং ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সিলেট অঞ্চলের একজন থানা শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, বরগুনার তালতলীর ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় ওই জেলার আমতলীতে আরেকটি বিদ্যালয়ের ছাদের অংশ ও বিম ভেঙে পড়ে। তিনি জানান, বাস্তবে সারা দেশে ২০ ভাগের মতো এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে। যেগুলো থেকে প্রায় প্রতিদিনই হয় বিম ভেঙে নয়তো ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। হতাহত নেই বলে পত্রিকায় আসছে না।
ডিপিইর এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কোনো প্রকৌশল শাখা বা বিভাগ নেই। এ কারণে প্রাথমিক স্কুল ভবন নির্মাণ করে এলজিইডি। এক শ্রেণীর ঠিকাদার সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিুমানের উপকরণ দিয়ে এসব ভবন তৈরি করেছে। ফলে নির্মাণের কিছুদিন পরই তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, যাচ্ছে প্রাণ। সম্প্রতি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের দক্ষিণ চালিতা বুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ শেষ না করা সত্ত্বেও গোটা বিল ঠিকাদারকে দিয়ে দেয়া হয়। অভিযোগের পর ওই ঘটনা আমলে নিয়ে এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করে। এটি গত ১০ এপ্রিল এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সুলতান হোসেন ডিপিইকে অবহিত করেছেন।
থানা শিক্ষা অফিসাররা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সম্পর্কে তথ্য পাঠানো হলেও ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হয়। এছাড়া ভবন নির্মাণ ও তদারকি নিয়ে ডিপিই এবং এলজিইডির মধ্যে আছে সমন্বয়হীনতা। বিশেষ করে নির্মাণকালে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের পক্ষে শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। উপজেলা প্রকৌশলী নির্মাণকাজ দেখভাল করেন আর নির্বাহী কর্মকর্তা বিল দিয়ে দেন। এ প্রক্রিয়ায় নির্মিত ভবনই কিছুদিন পর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, বিষয়গুলো আমাদের নজরে এসেছে। আমরা বিভাগীয় কমিশনারদের নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন জেলাপ্রশাসন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের এ মর্মে নির্দেশনা দেন যে, স্কুল ভবন নির্মাণ এবং সংস্কার কাজগুলো যথাযথভাবে তদারকি ও পর্যবেক্ষণের পরই বিল দেন। উপজেলা-জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদেরও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বরগুনার ঘটনায় যার বা যাদের অবহেলা প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে; যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এ ধরনের অবহেলা না করে। তিনি বলেন, ভবন নির্মাণকালে আমাদের বিভাগের কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। আমরা এখন এলজিইডির সঙ্গে নতুন চুক্তিতে যাব।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেন জানান, সারা দেশে ১৪ হাজার ৮৬৭টি স্কুল চিহ্নিত করে নতুন ভবন নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেগুলোর কাজ চলছে। এর মধ্যে নতুন জাতীয়করণ করা প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬ হাজার ৭১৭টি এবং পুরাতন ৮ হাজার ১৫০টি। এছাড়া সংস্কারের জন্য প্রতি বছর ৫ হাজার স্কুল চিহ্নিত করে বরাদ্দ দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৬৩৭টি এবং চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৬০৮টি ভবন সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
পৃথক প্রকৌশল বিভাগ গঠনের চিন্তা : প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থ ব্যয় করে। নিজেদের প্রকৌশল বিভাগ না থাকায় ভবন নির্মাণ করে দেয় এলজিইডি। এর আগে এ মন্ত্রণালয়ের ভবন নির্মাণ করত ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ। নিুমানের উপকরণে ভবন নির্মাণের ফলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ই নিজস্ব বিভাগ বা অধিদফতর প্রতিষ্ঠার চিন্তা করছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রী জাকির হোসেন শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা ভবন নির্মাণের জন্য এ সংক্রান্ত বিভাগ বা অধিদফতর গঠন করব। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
দেশে ৬৫ হাজার ৫৯৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৬ হাজার ১৬৫টি পুরনো। এসব জরাজীর্ণ ভবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি ২৬ হাজার স্কুল ভবন নতুন।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.