ভোটের আধুনিক যন্ত্র ইভিএমের আদ্যোপান্ত
ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন তথা ইভিএম ভোট গ্রহণের একটি আধুনিক যন্ত্র। নতুন বলে ইভিএম নিয়ে রয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সেটা নিয়ে নানা রকম বিতর্ক চলছে।
নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে আসন্ন ১১তম সংসদ নির্বাচনে কিছু কেন্দ্রে ব্যবহার হবে ইভিএম।
সাধারণের মনে প্রশ্ন ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন কী? সুবিধা কী? কীভাবে কাজ করে এই মেশিন? কোন কোন দেশে ইতোমধ্যে ইভিএম চালু হয়েছে।
ইভিএম কী
ইভিএম- পূর্ণরূপ হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন যা ভোটারের পরিচয় গোপন রেখে ভোট দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন হচ্ছে ভোট প্রদানের একটি সহজতর ব্যবস্থা। মেশিনটিতে একটি পূর্ব-প্রোগ্রামিং করা মাইক্রোচিফ থাকে যা প্রতিটি ভোটের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে হিসাব করে প্রদর্শন করে। এতে ব্যালট কাগজে সিল মারার পরিবর্তে ভোটার পছন্দ মতো প্রতীকের পাশের সুইচ টিপে ভোট দিতে পারেন।
ইভিএমের অন্য নাম ই-ভোটিং। ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় এটি একাধারে সঠিকভাবে ভোট প্রয়োগ ও দ্রুততার সঙ্গে ভোট গণনা করতে সক্ষম। আরও সরলভাবে বলা যেতে পারে ই-ভোটিং যন্ত্রটি হল একটি ৬-ভোল্টের ভোটিং বাক্স যাতে কিছু বোতাম থাকে যার প্রতিটি নির্দিষ্ট করা থাকে একেকজন প্রার্থীর জন্য। একজন ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীর জন্য নির্দিষ্ট বোতামটি চেপে তার ভোটটি দিতে পারেন। ভোট গ্রহণে স্বচ্ছতা এবং উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে ক্রমশই সমগ্র বিশ্বে এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চলেছে।
ইভিএম যেভাবে কাজ করে
ইভিএম কয়েকটি ইউনিটে ভাগ করা থাকে। ইউনিটগুলো হল : ১. ব্যালট ইউনিট : এই ইউনিটটি থাকে বুথের ভেতর। এর মাধ্যমে ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। ২. কন্ট্রোল ইউনিট : কন্ট্রোল ইউনিট থাকে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সামনের টেবিলে।
৩. ডিসপ্লে ইউনিট : ইভিএমের সঙ্গে একটি বড় ডিসপ্লে ইউনিট রাখা হয়, যা এমন স্থানে রাখা হয় যাতে বুথের ভেতর ভোট সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিগোচর হয়। ৪. ব্যাটারি ইউনিট : এ মেশিন চালাতে দরকার হয়
১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি। ব্যাটারিতে মেশিনটি সারা দিন চলতে পারে। ফলে বাড়তি কোনো বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় না। ৫. স্মার্ট কার্ড ও মাস্টার কার্ড : একটি ভোটিং মেশিন পরিচালনা করার জন্য সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে একটি করে আইডি কার্ড দেয়া হয়। এ কার্ড ছাড়া কন্ট্রোল ইউনিট পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। এ ইউনিটগুলো ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও তারের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
সাধারণত ইভিএম দুটি যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি। এর একটি হচ্ছে কন্ট্রোল ইউনিট এবং অপরটি হচ্ছে ব্যালটিং ইউনিট। প্রিসাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিট চালাবেন। তিনি কন্ট্রোল ইউনিট থেকে ব্যালটিং ইউনিট সক্রিয় করে দেবেন। তখন ভোটার ব্যালট বাটন চেপে তার তথ্য নিবন্ধন করবেন।
এই তথ্য নিবন্ধিত করার মাধ্যমে একজন ভোটার কেবল একবারই ভোট দিতে পারবেন। পরবর্তী ভোটারের জন্য আবার প্রিসাইডিং অফিসার ব্যালটিং ইউনিট সক্রিয় করে দেবেন। যদি কোনো ভোটার আবার ভোট দিতে চান তবে ইভিএম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোট গ্রহণ করবে না।
ইভিএমের সুবিধা
* ইভিএম ব্যবহারের ফলে ব্যালট ছাপানোর খরচ, কাগজের খরচ, এগুলো পরিবহনের খরচ, ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবলের খরচ সবই সাশ্রয় হবে।
* একটি মেশিন দিয়ে অন্তত পাঁচটি জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব। শুধু মেশিনটির প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করে চাইলে এটাকে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বা উপনির্বাচনেও কাজে লাগানো যাবে।
* এই প্রক্রিয়ায় কোনো ভোটারের ভোট বাতিল হবে না। ভোটের তথ্য মেশিনে প্রায় ১০ বছর ধরে অবিকৃত অবস্থায় থাকবে।
* এটির দ্বারা ভোট প্রদান করা খুবই সহজ এমনকি প্রতিবন্ধীদের জন্যও সহজ হয়েছে।
* একজন ভোটার ভোট দেয়ার পর ১০ থেকে ১২ সেকেন্ড ব্যালট ইউনিট স্বয়ংক্রিয়ভাবে অকার্যকর থাকে। ফলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ইচ্ছা করলেও একজন ভোটারকে একাধিক ভোট দানের সুযোগ করে দিতে পারবেন না।
* কোনো কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটলে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার কন্ট্রোল ইউনিটের ক্লোজ সুইচটি চেপে দিলেই দখলকারীরা কোনো ভোট দিতে পারবে না। তা ছাড়া ইভিএমের স্মার্ট কার্ড সরিয়ে ফেললেও মেশিনটি চালু করা যাবে না। আবার প্রতি মিনিটে ৫টার বেশি ভোট দেয়া যাবে না।
* খুব কম সময়ে ভোট গণনার কাজ সম্পন্ন হয়।
* এটি ব্যাটারি দ্বারা চলতে পারে তাই বিদ্যুৎ না থাকলেও কাজ করে।
ইভিএমের অসুবিধা
*ই-ভোটিং পদ্ধতিতে সহজেই প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করে জালিয়াতি করার সুযোগ থেকেই যায়। কেউ যদি প্রতি কেন্দ্রে অন্তত একটি করে মেশিনে এ প্রোগ্রাম করে দেন যে, নির্বাচন শেষে ক্লোজ বাটনে ক্লিক করলেই যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট কোনো প্রতীকে অতিরিক্ত ২০০/৩০০ ভোট যুক্ত হবে তাহলে সহজেই নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়া সম্ভব।
* জালিয়াতির একটি প্রধান উপায় হতে পারে এর কোনো যন্ত্রাংশ এমনভাবে বদলে দেয়া; যাতে ভোটার যে বোতামই চাপুন না কেন ভোট একজন প্রার্থীর পক্ষেই পড়বে। সে ক্ষেত্রে এটি হবে ভোট জালিয়াতির যন্ত্র। পোলিং অফিসার তাদের ইচ্ছামতো প্রার্থীকে জয়ী করবেন।
* পোর্টেবল হার্ডওয়ার ডিভাইসের সাহায্যে ভোটের রেকর্ড নিয়ে তা পরিবর্তন করে নির্বাচনের ফলাফলই বদলে দিতে পারে।
* ইভিএমে ডাটা এনক্রিপশনের ব্যবস্থা নেই বিধায় দ্বিতীয় পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে কারিগরিদিক থেকে সহজ!
* মাইক্রোকন্ট্রোলার চিপ নিয়ন্ত্রিত এই ইভিএমের প্রতিটি স্মার্টকার্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে আরএফআইডি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) ট্যাগ। অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতা পেলে কোনো প্রার্থীর কর্মীরা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে কয়েকশ মিটার দূর থেকেও কন্ট্রোল ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।
*এ যন্ত্রে ভোট গ্রহণ করা হলে জালিয়াতির ব্যাপারটি স্থানীয় নির্বাচন কর্মী দ্বারাই করা সম্ভব। ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থার আর দরকার পড়ে না!
বাংলাদেশে ইভিএম
২০০৭ সালে ঢাকার অফিসার্স ক্লাবের কার্যকরী সংসদের নির্বাচনে এ পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করা হয়। ছোট নির্বাচনে সফলতার পর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে এ প্রকল্প জমা দেন উদ্ভাবক, বুয়েটের আইআইসিটি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এসএম লুৎফল কবির এবং প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পাইল্যাব বাংলাদেশ।
তখন ছবি সংবলিত ভোটার তালিকার কাজ চলার কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
ইতোমধ্যেই আংশিক ও পরীক্ষামূলকভাবে ২টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের ১৪টি কেন্দ্রে ও নারায়ণগঞ্জের সিটি কর্পোরেশনের ৫৮টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ৫ জানুয়ারি ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত কুমিল্লার সিটি কর্পোরেশনের সব কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইভিএম
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইভিএম পদ্ধতি চালু রয়েছে। এ পদ্ধতি প্রথম চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালে। এর ৪ বছরের মধ্যেই ৭টি রাজ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে।
আইনগতভাবে আমেরিকা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, কাজাখস্তান, পেরু, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভেনিজুয়েলায় চালু রয়েছে ইভিএম প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোট গ্রহণ পদ্ধতি।
এ ছাড়া আর্জেন্টিনা, ইতালি, মেক্সিকো, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশকিছু দেশে এখনও এ ব্যবস্থা নিয়ে চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যদিও বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর প্রায় ৮৫ ভাগ দেশেই এ পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। এর পেছনে মেশিন যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে বাড়ছে নিত্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার। এরই ফলে হয়তো আমাদের দেশেও পুরোপুরিভাবে চালু হতে পারে ইভিএম। তবে বরাবরের মতোই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ভোটারাও কিছুটা সমস্যার সম্মুখীন হতেই পারেন।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.