রাফি হত্যার নেপথ্যে
৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা কেন্দ্রে গেলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা।আগুনে হত্যাচেষ্টার পর রাফিকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ওই ছাত্রীর মা। ২৭ মার্চ পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ। পরে পরিবারের করা মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। সেই মামলা তুলে না নেয়ায় অধ্যক্ষের লোকজন ওই ছাত্রীর গায়ে আগুন দিয়েছে।
নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন সর্বস্তরে সবখানে হয়। মাদ্রাসায় মেয়েরা কেন, ছাত্ররাও নিরাপদ নয়। যৌনবিকারগ্রস্ত পুরুষের কাছে সমাজের উঁচুস্তর থেকে নিুস্তর, পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন, কর্মক্ষেত্র সবখানে নিপীড়কের শিকার হন নারী। কেউ সমর্পণ করেন, কেউ মুখ বুজে সহ্য করেন, কেউ আবার প্রতিবাদ করেন। কেউ একজন লিখেছেন, ‘ঘুমিয়ে গেলি নুসরাত মা- বড্ড অস্থিরতায় আছি। প্রিয়জন হারানোর বেদনার মতো বুকটা ফাঁকা হয়ে আসছে।তবে কুৎসিত সোনাগাজীর (ফেনী) মানুষগুলোকে আর দেখতে হবে না তোকে, মা। যারা তোকে হত্যার নেপথ্যে তাদের মুক্তির জন্য মিছিল করে সেসব মানুষরূপী জানোয়ারদের দেখতে হবে না। ঘুমিয়ে যাও, আর আমাদের ক্ষমা করো, আমরা কিছুই করতে পারিনি। কতটা কষ্ট সয়েছিস, মা, শেষ কয়টা দিন। আল্লাহ নুসরাত জাহান রাফিকে শান্তির ঘুম দাও।’
যে দেশে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল বা হুজুর বা মাওলানা সাহেবের কাছেও হিজাব পরা ছাত্রী নিরাপদ নয়, সেই দেশে হিজাব, বোরকা বা অন্য যে কোনো ধরনের পর্দা মেয়েদের জন্য কতটুকু নিরাপদ? মেয়েদের হিজাব পরার কথা বলল, বোরকা-পর্দা করার কথা বলেই আমরা রেহাই পেতে পারি না। রাফির মৃত্যুর খবরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। অনেকে ফেসবুকে রাফির শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোসহ দোষীদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। আগুনে দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী রাফি বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় মারা গেছে (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। নুসরাতের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা আজকের নয়, এ মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে অনেক যোগ্য ও মেধাবী মানুষ তৈরি হয়েছেন, যারা সমাজে শান্তির আলো ছড়িয়েছেন। এটা অনেক পুরনো শিক্ষাব্যবস্থা। তাই আমি মনে করি, সমস্যা শুধুই মাদ্রাসায় নয়, মূল সমস্যা মাদ্রাসার দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং যাদের সহায়তায় অযোগ্য ও অথর্ব শ্রেণীর চরিত্রহীন লোকগুলো শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন এবং যাদের কাঁধে পা দিয়ে ওইসব দুর্নীতিবাজ লোক অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন তারা।
ফেসবুকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক লিখেছেন, “সারা শরীরে তীব্র ব্যথা নিয়ে মেয়েটি বলেছিল ‘আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই যাব। আমার জীবন থাকতে যে অন্যায় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আমার সঙ্গে করেছেন, জীবন থাকতে সে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না...।” ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়েই সাহসের সঙ্গে মেয়েটি বলেছে, ‘আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, সারা পৃথিবীর কাছে বলব এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য। আমি এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করব’... অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে করতে তীব্র ব্যথা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল মেয়েটি।এ বর্বরতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। মধ্যযুগ কাকে বলে? কত সাল থেকে কত সাল? মধ্যযুগের বর্বরতার ধরন কেমন ছিল? আমার মতো বর্তমানের চেয়ে মধ্যযুগ অনেক ভালো ছিল। আমরা বর্তমানকে অস্বীকার করি। বর্তমানের বর্বরতাকে ঢাকতে মধ্যযুগের তুলনা দেই। একটা মেয়েকে শিক্ষক নামধারী বদমায়েশ আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলল। এরপর আর মধ্যযুগীয় বর্বরতা কথাটা চলতে পারে না। রাফির এ দুর্ঘটনার সুবাদে কয়েক ধরনের মানবচরিত্র ধরা পড়ল।এক. নুসরাত নামের মেয়েটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী; তাই তাকে আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদ করেনি কোনো আলেম সমাজ। নিপীড়ককে দোররা মারার ফতোয়া দেয়নি। কারণ, নিপীড়ক সিরাজ উদ্দৌলা সেসব স্বার্থান্বেষী আলেম নামক ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতোই একজন পেশাদার শিক্ষক। আর এটা তো আমাদের সমাজব্যবস্থার সেই পুরনো ঐতিহ্য- অপরাধী যত বড় অপরাধই করুক না কেন, সে নিজেদের গোত্রের বা স্ব-পেশার লোক, তাকে তো বাঁচাতেই হবে।দুই. মেয়েটি মাদ্রাসার ছাত্রী এবং সিরাজউদ্দৌলা একজন সাবেক জামায়াত নেতা, তাই জামায়াত এ বর্বরতার বিরুদ্ধে কোনো শক্ত প্রতিবাদ করেনি।
তিন. মেয়েটি মাদ্রাসার ছাত্রী, তাই তাকে আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদ করেনি তথাকথিত প্রগতিশীলরা। সড়কে বিক্ষোভ দেখানো হয়নি। শাহবাগ দখল করেনি। বিভিন্ন দল-উপদলের রাজনীতিবিদরাও বিবৃতি দেননি।চার. মেয়েটি মাদ্রাসার ছাত্রী, বোরকা পড়ত, তাই তার প্রতি এমন নির্মমতার পরও ‘নারীবাদী সংগঠনগুলো কোনো প্রতিবাদ করেনি।’ মোমবাতি জ্বেলে স্লোগান দেয়নি। লাল টিপওয়ালা আপুরা প্লাকার্ড হাতে শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়নি।এ সবকিছুর পরও বলব, আমাদের দেশে এখনও অনেক বিবেকবান আছেন এবং আমি মনে করি, ওইসব ধান্ধাবাজ স্বার্থান্বেষী মহলের তুলনায় আমাদের মাঝে ভালো মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তবে শুধু সৎসাহসের অভাবে কেউ এগিয়ে আসে না। আমাদের জয় একদিন আসবেই- যথেষ্ট সীমালঙ্ঘন হয়েছে আর নয়। কারণ স্বয়ং আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীর জন্য কঠিন সাজা নির্ধারণ করে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে, সূরা বাকারা, আয়াত ১৯০, আল্লাহ বলেছেন, ‘আর আল্লাহর পথে তোমরা যুদ্ধ করো তাদের বিরুদ্ধে যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, আর সীমালঙ্ঘন করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’
মেজর রেজা উল করিম, ইবি (অব.) : নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
সূত্র- যুগান্তর
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.