বাঙালির কাঁকড়া-নীতি
‘বাঙালির কাঁকড়া-নীতি’ নিয়ে প্রচলিত গল্পটি ইদানীং বেশ শোনা যাচ্ছে। এ শব্দবন্ধটির সঙ্গে আমরা পরিচয় হয় আশির দশকের প্রথমদিকে। প্রখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব গুহ তার ‘ভাবার সময়’ নামের প্রসিদ্ধ একটি উপন্যাসে প্রসঙ্গক্রমে এমন একটি গল্পের অবতারণা করেন।
একজন মাড়োয়ারি কাঁকড়া ব্যবসায়ী ট্রেনে মালের বগিতে কয়েকটি ড্রামভর্তি কাঁকড়া উঠিয়ে নিজেও পাশেই বসা ছিলেন। ড্রামের ওপরের অংশ খোলা এবং ভেতরকার জীবন্ত ‘মাল’দের কিলবিল লক্ষ করে অন্য এক লোক তাকে বলল! ‘ভায়া, ওগুলো তো ড্রাম বেয়ে বেয়ে সরে পড়বে; ভালো করে ওদের সামলান।’
শুনে মাড়োয়ারি কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ বা ইতস্ততা না করে ঝটপট বলে উঠেন- ‘আরে না, এগুলো বাঙালি কাঁকড়া। কখনও সরবে না। ওপরে উঠে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।’ লোকটি কৌতূহলী হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে- ‘কেন যাবে না, তা আমাকে খুলে বলুন তো?’ এবার মাড়োয়ারি বলে চলেন- ‘বাংলা মুলুকের বাঙালি কাঁকড়ার আচার-বৈশিষ্ট্য এই যে, সে সহজে কাউকেই ওপরে উঠতে দেবে না।
যদি কোনোটি তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে ওপরের দিকে খানিকটা উঠেও পড়ে, অমনি স্বগোত্রীয় অন্যরা কেউ ঠ্যাং, কেউ হাত বা অন্য কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধরে এমন জোরে হেঁচকা টান দেবে যে, তার পক্ষে ওঠা তো দূরের কথা, আগের অবস্থানে না নেমে আর উপায় থাকে না। অতএব কোনো নজর না রাখলেও ড্রাম থেকে কাঁকড়াদের সরে পড়ার কোনো কারণ বা সুযোগ নেই।’
বাঙালির কাঁকড়া-নীতির প্রসঙ্গটি পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারতের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে সে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়টিতে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে এককভাবে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় নয়াদিল্লিতে তখন ঝুলন্ত এক সরকার। নরসীমা রাওয়ের মেয়াদান্তে (১৯৯১-১৯৯৬) একে একে দু-তিনজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
এ সময় বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে বর্ষীয়ান সিপিআইএম নেতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর (১৯১৪-২০১০) প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ দেখা দেয়। দেশি ও বিদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিবেচনাতেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতিবাবুর শপথ নেয়ার বিষয়টি ছিল তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু এতে শেষ পর্যন্ত বাদ সাধেন জ্যোতি বসুর নিজহাতে গোছানো প্রিয়দল সিপিআইএমেরই কিছু নেতা ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলে পরিচিত রাজনীতিক। এক্ষেত্রে ইঙ্গিত করা হয়, ‘বাঙালি বাবু’ জ্যোতি বসুর এত উচ্চ একটি পদে অধিষ্ঠানকে তারা মেনে নিতে নারাজ।
কোনো কোনো নেতার দেয়া ‘দলের নীতি ও আদর্শের’ দোহাইকে তিনি অতিক্রম করতে না পারায় আর অগ্রসর হতে পারেননি। গদিতে বসলে এটাই হতো কোনো বাঙালির পক্ষে প্রথমবারের মতো দিল্লির গদির স্বাদ গ্রহণ। কিন্তু হলে কী হবে, শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।
এমনই ঘোলাটে এক পরিস্থিতিতে ‘আপনাকে যদি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাহলে আপনি কী করবেন’- সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে জ্যোতি বসু শুধু এটুকুই বলেন, ‘আমার মাথা এখনও ঠিক রয়েছে।’ সুযোগ সৃষ্টি হলেও মূলত ‘কাঁকড়া-নীতির’ কারণে পশ্চিমবঙ্গবাসীর আশা নিরাশায় রূপ নেয়। আর এভাবেই ‘বাঙাল’রা স্বস্তি পায় সে সময়!
প্রধানত এ কাঁকড়া-নীতির কারণে প্রশাসনিক ও আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পদ-পদবি এবং পদোন্নতি পাওয়া থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত করা হয়েছে বা বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে এমন উদাহরণ চারপাশে ভূরিভূরি রয়েছে। ‘আমি হতে পারি না বা হতে পারিনি; কিন্তু তোমাকেও হতে দিইনি, হতে দেব না; যেভাবেই হোক ঠেকিয়ে দেব বা ঠেকিয়ে দিয়েছি!’- আরও কত ধরনের আত্মপ্রবোধ! রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, এমনকি খোদ সরকারি প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও এমনটি হরহামেশাই লক্ষ করা যায়।
‘সাত কোটি বাঙালিরে আর দাবিয়ে রাখতে পারবা না’- তর্জনী উঁচু করে বঙ্গবন্ধুর গগনবিদারি এ হুংকার ছিল যথার্থ। বাস্তবিকই তো, অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে দীর্ঘদিনে হলেও অবাঙালি সশস্ত্র শক্তিমান শাসক-শোষকগোষ্ঠীর রোষানল-কোপানল-দাবানল থেকে শেষ পর্যন্ত বাঙালির রেহাই মেলে; কিন্তু স্বগোত্রীয়দের ঈর্ষা-পরশ্রীকাতরতার বেড়াজাল থেকে বুঝি তার আর রেহাই নেই! বাঙালির কাঁকড়া-নীতির বহুল চর্চা লক্ষ করা যায় একেকটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার দিকে তাকালে।
এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তো সর্বাগ্রগণ্য। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে খুব কম প্রতিষ্ঠানকেই আলাদা রাখা যাবে, যেগুলো এহেন হীনচর্চা থেকে মুক্ত। পদ-পদবি ও পদোন্নতি পাওয়ার লোভ।
বিশ্ববিদ্যালয় হলে ভিসি, প্রোভিসি, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার, ডিন, প্রভোস্ট, বিভাগীয় প্রধান, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির প্রধান- আরও কত আকর্ষণীয় ও লোভনীয় পদ এবং সম্মান! আর কলেজ হলে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ বা হোস্টেল সুপার- আর আকর্ষণীয়-লোভনীয় বিভিন্ন কমিটি তো রয়েছেই।
ডিঙাতে হবে, ডিঙাতেই হবে- একজন, দু’জন কিংবা প্রয়োজনে আরও বেশিজনকে। কেবল অন্যদের ডিঙানো নয়, যেভাবেই হোক বাগিয়েও নিতে হবে কাঙ্ক্ষিত ‘সোনার হরিণটি’। কেবল ‘কাঁকড়া-নীতি’র কোপানলে পড়ে যোগ্যতা-মেধা থাকা সত্ত্বেও পদ-পদবি ও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বছরের পর বছর, এমনকি জীবনভর বঞ্চিত থাকতে হয়েছে- চারপাশে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে।
বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা ও সংগঠন, বিশেষ করে বড় বড় রাজনৈতিক দল ও এসবের জোট-মোর্চার আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একেকটি পদকে কেন্দ্র করেও বাঙালির কাঁকড়া-নীতির চর্চা এবং বহিঃপ্রকাশ হরহামেশা লক্ষ করা যায়।
‘আমিই যোগ্য’, ‘আমিই হব’, আমি ঠেকাব’, ‘পারলে ঠেকাও’- মূলত এসব সামাল দিতেই নাকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে ‘সময়ের প্রয়োজনে’ আকর্ষণীয় নাম দিয়ে বিভিন্ন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.