দখল-ভরাটে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ঢাকার খাল
ষাটের দশকেও রাজধানীর খালগুলো ছিল মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ছিল প্রাণবন্ত। কিন্তু এখন এ খালগুলোর অধিকাংশেরই মরণদশা। এসব খাল ভরাট করে অবৈধভাবে দোকানপাট, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন প্রভাবশালীরা।আবর্জনায় পরিপূর্ণ কোনো কোনো খাল বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। এসব খালের পানি নিষ্কাশন ক্ষমতাও হারিয়ে যাচ্ছে। বারবার অভিযান চালিয়েও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে সফল হতে পারছে না ওয়াসা। ফলে এবারও বর্ষায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যাত্রাবাড়ী থানার কাজলা ও ধলপুরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের স্বচ্ছ পানির দেবধোলাই খাল বর্তমানে বিপন্ন। ওয়াসার সাইনবোর্ড থাকলেও সবার সামনেই ভরাট হয়ে গেছে খালের বিরাট অংশ। খালের ওপর বাজারও চলছে বহাল তবিয়তে।অন্যদিকে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর খাল দেখে চেনার উপায় নেই এটি একটি খাল। খাল পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। খালটি চেনার জন্য ঢাকা ওয়াসা কাটাসুরের নামাপাড়ায় একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গালেও সুফল আসেনি। দখল-দূষণে এটি অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
খোদ ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথ নজরদারির অভাবে সতর্কবাণী বা সাইনবোর্ড দিয়েও খালের অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাদের মতে, সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় কয়েকটি খালে কঠিন বর্জ্য এমনভাবে জমেছে যে, শক্তিশালী যন্ত্র দিয়েও সরানো যাচ্ছে না। খালের ওপর অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে আরসিসি এবং স্টিলের সেতু। কখনও কখনও খাল খনন কিংবা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও পরবর্তী সময়ে আবারও ভরাট কিংবা বেদখল হয়ে যাচ্ছে।জানা যায়, রাজধানীতে একসময় ৪৩টি খাল ছিল। এখন ১৭টি খালের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। টিকে থাকা ২৬টি খালও অনেকটা প্রাণহীন। এসব খালের মোট দৈর্ঘ্য ৭৯ হাজার ৮০৬ মিটার বা প্রায় ৮০ কিলোমিটার।
এর বাইরে সায়েদাবাদ থেকে দয়াগঞ্জ, রাসেল স্কয়ার থেকে গ্রিন রোড চৌরাস্তা, মহাখালী থেকে নিকেতন বক্সকালভার্ট, ইব্রাহীমপুর বক্সকালভার্ট- প্রায় ১০ কিলোমিটার খাল ভরাট করে বক্সকালভার্ট করা হয়েছে।এ কারণে বর্ষায় পানি নিষ্কাশনে এসব খাল কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এছাড়া বিদ্যমান ২৬টি খালের মধ্যে পাঁচটি খাল (হাজারীবাগ, বাইশটেকী, কুর্মিটোলা, মাণ্ডা ও বেগুনবাড়ী) ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড হয়ে রয়েছে।ওই খালগুলো উদ্ধারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। সেজন্য গত বছরের এপ্রিলে ৬০৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। বর্তমানে ওই প্রকল্পের কাজ চলমান। ঢাকা ওয়াসা এটি বাস্তবায়ন করছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. কামরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর খালগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দখলমুক্ত রাখার দায়িত্ব ওয়াসার। এই দায়িত্ব ওয়াসা আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করছে। নগরবাসীর অসচেতনতার কারণে নগরীর অনেক খাল দখল ও ভরাট হচ্ছে। এ ব্যাপারে নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে।তিনি আরও বলেন, ঢাকা ওয়াসা নগরীর বিদ্যমান খালগুলোকে টেকসইভাবে টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে খালগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর খালগুলোর মালিক ডিসি অফিস। কিন্তু এর সার্বিক দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ডিএসসিসি তার অবস্থান থেকে ওয়াসাকে সহযোগিতা করছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে।অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার খালগুলোর বিদ্যমান চিত্র সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখেছি, খালগুলো নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এসব খাল সংস্কারের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এজন্য ওয়াসার সংশ্লিষ্টদের বিষয়গুলো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে খাল উদ্ধার, সংস্কার কাজে ওয়াসাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে ডিএনসিসি।
জানা যায়, ইব্রাহিমপুর খাল, দিয়াবাড়ী খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, সেগুনবাগিচা খাল ও খিলগাঁও-বাসাবো খালে অবৈধ স্থাপনা ও বাড়িঘর উঠেছে। বর্ষা এগিয়ে এলেও খালগুলোকে দখলমুক্ত করতে পারেনি ওয়াসা।সেগুনবাগিচা খালের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৮৫০ মিটার। এ খালটি ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। খালের ওপর অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে আরসিসি ও স্টিলের সেতু। একাধিক সেতু উচ্ছেদ করা হলেও প্রভাবশালীরা আবারও নির্মাণ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে।কঠিন বর্জ্যে ভরে আছে মাণ্ডা খাল (৫ হাজার মিটার), খিলগাঁও-বাসাবো খাল (১ হাজার ৫৫০ মিটার), মহাখালী খাল (১ হাজার ৩২০ মিটার) এবং দেবধোলাই খাল (২ হাজার মিটার)। মিরপুরের দেওয়ানপাড়া এলাকায় বাউনিয়া খালের বিরাট একটা অংশ বেদখল হয়ে আছে।
কয়েক বছর ধরে ঢাকা ওয়াসা এখানে খাল উদ্ধার ও ৮০০ মিটার অংশ খনন করলেও বেদখল হতে চলেছে খালটি। কল্যাণপুর প্রধান খাল ও কল্যাণপুর ‘ঙ’ খালও আবর্জনায় ভরা।নির্গমন পথ না থাকায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে মিরপুর বেনারসী পল্লীর বাইশটেকি খাল (আংশিক)। বর্তমানে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ওপর দিয়ে খালের পানি প্রবাহিত হচ্ছে।কল্যাণপুর ‘ক’ খালের ভাটিতে খাল উধাও হয়ে গেছে। খালের পানি এখন প্রবাহিত হচ্ছে খালেক সিটির ভেতরে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ দিয়ে। মিরপুর সাংবাদিক কলোনি খালের ভাটি অংশের প্রশস্ততা মাত্র তিন ফুট। কোথাও আরও কম।
খাল দুটির জন্য জমি অধিগ্রহণের কথা বহু বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওয়াসা তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। মুসলিম বাজার খাল, কল্যাণপুর ‘চ’ খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল (বেড়িবাঁধের ভেতর), কাটাসুর খাল, কল্যাণপুর ‘খ’ খাল, কালুনগর খাল, ওয়াসা প্রতি বছর বিপুল অর্থ খরচ করে পরিষ্কার করলেও কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না।হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সাদেক ফিলিং স্টেশন পর্যন্ত পাইপ লাইন দিয়ে হাজারীবাগ খালের একাংশের পানি প্রবাহিত হয়। ওয়াসা বহুদিন ধরে বলে আসছে এই পাইপ লাইন অপসারণ করে খাল খনন করা দরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত ওয়াসা এ কাজ শুরুই করতে পারেনি।
এর ফলে আসন্ন বর্ষায়ও হাজারীবাগের বাসিন্দাদের জলাবদ্ধতায় পড়তে হতে পারে। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের কারণে ভরাট হয়ে গেছে রূপনগর প্রধান খালের ভাটির অংশ। এ কারণে খালের পানি নিষ্কাশন করা হয় পাইপ লাইনের মাধ্যমে। বর্ষায় একটু বেশি বৃষ্টি হলে এই পাইপ লাইন দিয়ে দ্রুত পানি সরতে পারে না। ফলে এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ওয়াসা এই পাইপ লাইন অপসারণ করে খাল খননের কথা বললেও আসন্ন বর্ষায় নগরবাসী খুব একটা সুফল পাবে না।
No comments
If you have any doubt, please let me know that with your valuable comments.